রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

ওমর খৈয়াম— রায়ান নূর

ওমর খৈয়াম
           রায়ান নূর

ওমর খৈয়াম,তার পূর্ণ নাম গিয়াস উদ্দীন আবু আল-ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম আল-নিশাপুরী আল-খাইয়ামী ৷ (জন্ম 18 ই মে 1048,নিশাপুর,খোরাসান ৷ মৃত্যু 4ই ডিসেম্বর 1131,নিশাপুর)

পারস্যিক গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং কবি ৷ সমসাময়িককালে নিজ দেশে তার বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞার জন্য তিনি প্রখ্যাত ছিলেন কিন্তু ইংরেজ লেখক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড অনূদিত "রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম(1859)" প্রকাশের পর তিনি ইংরেজ ভাষাভাষীদের কাছে প্রধানত পরিচিতি লাভ করেন তার রুবাইয়াৎ(চতুষ্পদী কবিতা) সংকলনের মাধ্যমে ৷

তার নাম খৈয়াম(তাবুকার) তার পিতার বৃত্তি বা পেশাসুত্রে এসেছে অনুমিত হয় ৷  তিনি সমরখন্দ(উজবেকিস্তান ) গমনের পূর্বেই নিশাপুরেই বিজ্ঞান ও দর্শনে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন ৷ সমরখন্দে তিনি বীজগণিতের উপর  "রিসালাহ ফিল-বারাহিন আল-মাসাইল আল-জেবরা ওয়াল-মুকাবিলাহ(বীজগনিতের সমস্যার প্রতিপাদন সূত্র) পুস্তক রচনা সম্পন্ন করেন যা গণিতে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণস্বরূপ ৷এই পুস্তকে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণকে মোচাকৃতিবর্গে ছেদন প্রক্রিয়ায় সমাধানে পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা দিয়েছেন ৷ প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তার কাজের পূর্বসূত্র যা তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় আবু আল-ওয়াফার ফলাফল ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক মূল সংখ্যাকে ভেঙে নয়মাত্রার বিচ্ছিন্ন সংখ্যার উপর প্রতিস্থাপনের উপর ভিত্তি করে মৌলিক পুরো সংখ্যা পেতে ৷

তিনি এমন খ্যাতি পেয়েছিলেন যে সেলযুক সুলতান মালিক শাহ বর্ষপুঞ্জি প্রণয়নের প্রয়োজনে তার জ্যোতির্বিদ্যাজাত দুরদর্শিতা পরখ করতে তাকে ইস্পাহানে অামন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ৷ সেখানে একটি মানমন্দির তৈরি করা হয় এ কাজ সম্পন্ন করতে এবং "জালালী বর্ষপঞ্জি" নামে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি হয় প্রত্যেক 33 বছরে 8 বছর অধিবর্ষের ভিত্তিতে ৷ এটি বর্তমান গ্রিগোরিয়ান বর্ষপঞ্জির তুলনায় তখন অনেক সঠিক ছিল এবং 1075 খ্রীঃ মালিক শাহ কর্তৃক গৃহীত হয় ৷এছাড়াও ইস্পাহানে তিনি ইউক্লীডিয় সমান্তরাল ও সমানুপাতিক স্বীকার্যের উপর গঠনমূলক সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেন ৷ সেই সূত্রে তৎকালিন তার ধারণা  অবশেষে ইউরোপে নতুনমাত্রা তৈরি করেছিল যেখানে তারা ইংরেজ গণিতবিদ জন ওয়ালিসের(1616-1703) উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং পরবর্তীতে তিনি  বিস্তারানুপাত যুক্ত করে সংখ্যার ধারণাকে  সমৃদ্ধ করার জন্য মূল্যবান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন( যেমন অমূলদ সংখ্যা√2 এবং π) ৷

তার সময়ে ইস্পাহান নগরী অনেক সমৃদ্ধ ছিল কিন্তু 1092 খ্রীঃ তার পৃষ্ঠপোষক সুলতানের মৃত্যুর পর বিধবা পত্নী তার উপর ক্রোধান্বিত হন এবং  তার অল্পকাল পরেই ওমর মক্কায় পবিত্র হজ্ব পালন করতে যান ৷ তারপর তিনি নিশাপুরে প্রত্যাবর্তন করেন যেখানে জ্যোতির্বিদ হিসেবে তিনি শিক্ষা ও সেবা দান করেন ৷ দর্শন,আইন,ইতিহাস,গণিত,চিকিৎসা এবং জ্যোতির্বিদ্যা বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করেছিলেন এই প্রতিভাবান ব্যক্তি ৷

ওমর খৈয়াম পাশ্চাত্যে খ্যাতি পেয়েছেন তার উপর আরোপিত সংকলিত "রুবাইয়াৎ" অথবা "চতুষ্পদী কবিতা" র মাধমে৷ (চতুষ্পদী কবিতা হল চার লাইনের পংক্তিসম্পন্ন যেখানে ছন্দবিন্যাস প্রধানত কককক অথবা ককখক ;এটি আধাত্নিক জ্ঞানে বিশেষ ছন্দবদ্ধ )
ওমরের কবিতার আবেদন তুলনামূলকভাবে কম আকৃষ্ট করেছিল যতক্ষন না পর্যন্ত তারা ফিটজেরাল্ড গ্রন্থিত"রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম" এর নতুন জনপ্রিয় বাক্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত না হয়  ৷ যেমন,

"এক পেয়ালা মদ,এক টুকরো রুটি এবং তুমি"
"নগদ যা পাও হাত পেতে নাও"এবং
"ফুল ফোটে হঠাৎ নিত্য মরার তরে  "

এই চতুষ্পদী কবিতাগুলো প্রায় সকল প্রধান প্রধান ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং পারস্য সম্বন্ধে ইউরোপবাসীদের ধারণাকে অতিরঞ্জিত করার জন্য ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে ৷কিছু পন্ডিত ওমরের কবিতা লেখা প্রসঙ্গে সন্দিহান ৷ তার সমসাময়িকরা তার কবিতার কোন আলামত পান নি এবং  মৃত্যর দুই শতাব্দীর পরে তার নামযুক্ত কিছু কবিতা না পাওয়া পর্যন্ত ৷
পরবর্তীতে কখনো কবিতাগুলোকে বিশেষ মতামতের বিরুদ্ধে উদ্ধৃতি হিসেবে অধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায় বাহ্যত ওমরের নামে,শীর্ষস্থানীয়  কিছু পন্ডিত সন্দেহপোষণ করেন যে তারা ওমরকে আবিষ্কার ও আরোপিত করে থাকতে পারে তার পান্ডিত্বসুলভ খ্যাতির জন্য ৷

ওমরের প্রত্যেকটি চতুষ্পদীই এক একটি পূর্ণ কবিতা ৷ইনি ফিটজেরাল্ড যিনি ধারনা পোষণ করেছিলেন রুবাইয়াতগুলোকে একত্র করে ক্রমগাঁথা তৈরিতে যেগুলোতে আধ্যাত্মিক ঐক্য ও সমন্বয় ছিল ৷ ফিটজেরাল্ডের  প্রতিভা এবং নিটোল শব্দচয়ন তার অনুবাদকে কালান্তরিত প্রাঞ্জলতা ও তেজদীপ্ত করেছে ৷ তারা,এতদসত্ত্বেও,এই চতুষ্পদীগুলোর অধিক ভাবানুবাদ এবং অতিসম্প্রতি এর অনেক বিশ্বাসযোগ্য অনুদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ৷

ফিটজেরাল্ডের ও অন্যান্যদের অনুদিত পঙ্কতি মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে—দ্বারস্থ করেছে বাস্তব-প্রকৃতি ও চিরন্তনতা, অনিশ্চিত ও নশ্বর জীবন,মানব-বন্ধনের স্বর্গীয়রূপ  ও পারলৌকিকতা,আচারসর্বস্ব ধর্মের স্থায়ীত্ব,এবং নশ্বর মানবের প্রখর-অনুভব ও অজ্ঞতা সমন্ধীয় প্রশ্নের ৷ তার মস্তিকে জটিল এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলেনি,তাই তার ধর্মবিশ্বাসভিন্ন পার্থিব জগতকেই তিনি ক্ষণিক ও ইন্দ্রীয় সৌন্দর্যের রস উপভোগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ৷
তিনি নির্মোহ পরিতুষ্টির নির্মল প্রশস্তি রচনা করেছেন ৷ এতদসত্ত্বেও তিনি মৌলিক আধ্যাত্মিক প্রশ্নে তার সততা ও একাগ্র অনুধ্যান বিসর্জন দেন নি ৷