শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

রেজাউল করিম রনিঃগোলাপ সন্ত্রাস—রায়ান নূর

"গোলাপ সন্ত্রাস" নামটা শুনলেই কেমন একটা প্রশ্ন দানা বাঁধে মনে ৷ স্বপ্ন নয় সত্যি এটা একটা কাব্যগ্রন্থ ৷ কবি রেজাউল করিম রনি রচিত এই কাব্যে মোট আটান্নটি কবিতা আছে বিভিন্ন সাধের ৷ সকলেই কবিতার বিভিন্ন রস উপভোগ করেছেন কিন্তু এই কাব্যের রস স্বতন্ত্র এবং আলাদা ছাঁচে তৈরি পাঠকগন না পড়লে হয়ত বুঝবেন না ৷ সমালোচনার খাতিরে নয় বরং আলোচনার তাগিদে ৷ শব্দের অপভ্রংশও কতটা সুখকর তার নিদর্শন এই কবিতাগুলি ৷কাব্যের অনেক কবিতায় নজর বুলিয়েছি যা কিছুটা মন কাড়ার মত ৷

আসমান ধরে টানাটানি করে
পাটখড়ির শাশুড়ি,মিহি সাপ তোলে ফুঁস-ফনা ৷
আবার,

আকাশের চেয়ে অনেক বিরাট আকাশ
—এই রিদয়ের মনোভূমি ৷
ঘাসের বুকে পৃথিবী হয়ে—জীবন
মুছে দেয় চাঁদের কলঙ্কজমি ৷

এমনই আরো অনেক কবিতা নজর কাড়ার মত ৷ পাঠক সংখ্যা সে বিবেচনায় আলোচনার বাইরে ৷ দ্বিতীয় দশকে এ যেন আরেক নতুন সংস্করণ ৷ কবিতার ভাবগুলো মহাকাব্যের ঢং এ স্বর্গ মর্তও পাতাল ব্যাপি বিচরণ করছে ৷গ্রাম্য নষ্টালজিয়া অনুভূতিগুলো নতুন সুরে জাগ্রত করে এই কবিতা গুলো

সূর্য ওঠে প্রতিদিন,বাঁশবাগানের আঁড়ে,কড়ুই গাছের ফাঁকে
বরিল বিলের বাঁকের বাতর ঘেষে
সূর্য ওঠে আমাদের বাঁশঝাড়ের বকের বাসায় পাশ ঘেঁষে ৷

কবিতাপ্রেমীদের কাছে এই কাব্য চোখ ধাধানো রঙে আবির্ভূত হবে ৷ বইটি পাওয়া যাচ্ছে একুশে বইমেলার "আদর্শ "স্টলে ৷ মূল্য—150 টাকা ৷
 

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জগলুল হায়দারঃ হাউ মেনি পেডি টু হাউ মেনি রাইস—রায়ান নূর

বাংলাদেশের ছড়ার যাদুকর ও বিজ্ঞান ছড়ার জনক জগলুল হায়দারের সমকালীন একটি ছড়ার বই আজ প্রকাশ হয়েছে যার নাম"হাউ মেনি পেডি টু হাউ মেনি রাইস'। এটি আমাদের লোক সমাজে প্রচলিত একটি বাক্যবন্ধ যার বাংলা ভাষান্তর করলে দাঁড়ায় "কত ধানে কত চাল"৷ বইটা বইমেলায় আসার আগেই আমার হাতে এসেছে তাই অনুভূতিটা একটু অন্যরকম অর্থাৎ এই বইয়ের প্রথম পাঠক আমি ৷এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছড়া গুলো হচ্ছে;←দলীয়করণ←ছাগলশুমারী←ফেল←জোড়াতালির রাশিফল←হাউ মেনি পেডি টু হাউ মেনি রাইস←আমার সোনার বাংলা←দৌড়←খবরদারী←নিয়মের ব্যাকরণ←সর্বদল←টক টক টক্কর←বুনো মুনো←জিনিস←গদির গান←পাওয়ার←বাংলা ছাড়ো←থ্রিজি←সময়ের ধ্বনি← চাপা←সূর্য যদি←আর করো না←হিসাব করে←পূর্বপশ্চিম←ফাল মারে←ধ্বস←ঘুরে ফিরে←সাটেলাইট অপঃকালচার←রোদ হেসেছে←থামান←তিন পথ←শেষমেষ←নাভিশ্বাস←সুন্দরবন সুন্দর বোন←রাজশিশু←জ্যাম←হচ্ছে কি সব←লানৎ←নিষ্ফলা সহ চল্লিশটি ছড়া রয়েছে ৷ জগলুল হায়দার এর ছড়া মানেই ধুন্ধুমার কাণ্ড। এক আশ্চর্য আকর্ষণ। তাই সব কয়টি ছড়া একরাতেই পড়ে শেষ করেছি ৷ সবগুলো ছড়া একেক রকম ভাব ভঙ্গিমায় এক কথায় অসাধারণ ৷ একবার পড়লেই তার তাল মনে যেন নিমিষে গেঁথে যায় ৷ তার কয়েকটি লাইন যেমন—

স্যাট চ্যানেলে প্যাট দেখা যায়
কাজল জুহি আলিশার
সবই চলে রসাতলে
টিভি দেখাই খালি সার!

আবার,

মন্ত্রী ডেকে রাজা হাঁকেন
নোটিশ দিয়ে বলিও—
এখন থেকে প্রশাসনে
সবাই হবেন দলীয় ৷

টার্মিনাল আর হলের পর
দখল হবে গলিও
দলের নামেই চাঁদ উঠবে
ফুটবে ফুলের কলিও ৷

পাঠকদের আরেকটি সুখবর যেটা হল,বিখ্যাত ছাগলশুমারী ছড়াটাও এই বইয়ে থাকছে ৷ বইটি যদি কেউ না পড়েন তবে অনেক মিস করবেন এক আশ্চর্যকর অনুভূতি থেকে কেননা এটি এবারের মেলার ব্যতিক্রমধর্মী ছড়ার বই ৷বইটি প্রকাশ করেছে "উদাহরণ প্রকাশন"৷ বইটি পাওয়া যাবে একুশে বইমেলায় অঙ্কুর প্রকাশনীর স্টলে (৩১১-৩১৩) ৷মূল্যঃ100 টাকা

শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কবি মনসুর আজিজঃজীবনের খেরোখাতা(অতলান্ত নীল চোখ)—রায়ান নূর

কবি মনসুর আজিজ সাম্প্রতিক কালে খুব সুন্দর কবিতা লেখেন ৷ তার কবিতার প্রধান অলঙ্কার উপমা ও চিত্রকল্প ৷ তার একটি কবিতা আমার নজর কেড়েছে হঠাৎ 'জীবনের খেরোখাতা'৷ এই কবিতাটি "অতলান্ত নীল চোখ(2002)" শীর্ষক কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতা ৷কবিতাটি আমার কাছে মনে হয়েছে হঠাৎ বিশেষ থেকে সামান্যে প্রত্যাবর্তন ৷ কবিতাটিতে কত গুলো উপমা প্রয়োগ হয়েছে যেগুলো সাহিত্যে নতুন ৷ পাঠকের কাছে হয়ত কবিতাটির ভাবার্থ অন্যভাবে ধরা দিবে কিন্তু তার সমালোচনা করলে তাকে তুচ্ছ বলা হবে না ৷"নীল অতলান্ত চোখ" এর একটি চোখ অন্তত এখানে দাড়াতে বাধ্য ৷ কয়েকটি উপমা,প্রতীক লক্ষ্য করা যাক—

হিংস্র নখর—নখরের(নখ) ন্যায় হিংস্র ৷
হৃদয় নহর—নহরের মত বহমান হৃদয় ৷
হিংসা বহর—হিংসা বহনকারী বাহনসমষ্টি ৷
শান্ত দুপুর—দুপুরের ন্যায় শান্ত যে ছবি ৷
ঘাসকুঁড়ি—কুঁড়ির ন্যায় প্রস্ফুটিত ঘাস ৷
খেরোখাতা—খেরুয়া কাপড়(লাল বর্ণের সুতা) দ্বারা মোড়া খাতা (দীনবন্ধু মিত্র কর্তৃক ব্যবহৃত শব্দ)

এই উপমাগুলো একবারে নতুন ৷ শব্দ ব্যবহারে কবির দক্ষতা রয়েছে ৷ কিন্তু তা কতটা প্রাসঙ্গিক তা আলোচ্য বিষয় হতে পারে ৷ কবির জীবনের ইতিবৃত্ত খানিকটা ফুটে ওঠেছে এই কবিতায় ৷ বিদেশী কতগুলো শব্দ কবি আত্নগত করেছেন নিপূনভাবে যেমন— নহর;মনজিল;জানোয়ার;ফার্নেস ৷

আলোচনায় আসা যাক প্রথম চার পঙ্কতিঃ


এলোমেলো হল আজ জীবনের খেরোখাতা
ঢেউ ভাঙে তীর ভাঙে জীবনের স্মৃতি ভেঙে বহু ভাজ
নরম ঘাসের পরে হেটে যায় হিংস্র জানোয়ার
ঘাসকুঁড়ি কেঁপে ওঠে কেঁদে ওঠে কাঁপিয়ে ভুবন ৷

কবির অবসাদ গ্রস্তের একটি দারুন চিত্রকল্প ৷ জীবনের খেরোখাতা এলোমেলো হয়ে কবির স্মৃতির তীর ভেঙে করেছে খন্ডিত ৷আর এর পেছনে কবি কারণ নির্দেশ করেছেন তার সমতল,বহমান স্থিতিস্থাপক জীবনে হিংস্র জানোয়ারের ন্যায় কতিপয় মানুষ হেঁটে চলে তার স্বপ্নগুলোকে বাধাগ্রস্ত করেছে ৷ এই লাইনগুলোতে যতিচিহ্নের প্রতি কবির অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে ৷ এখানে যতিচিহ্ন প্রয়োগ হত দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে যা কবির ইচ্ছাকৃত অথবা অনাকাঙ্খিত ভুল সিদ্ধান্ত ৷ আবার কবির একটি বাক্য
"ঢেউ ভাঙে তীর ভাঙে জীবনের স্মৃতি ভেঙে বহু ভাজ"৷ 
ঢেউ ভাঙে শব্দটা প্রায়োগিক দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ কেননা ঢেউ ভাঙতে পারে না কিন্তু তীর ভাঙতে পারে ৷ ঢেউ যদিও ভাঙে তা জলাশয় হবে এবং স্থবির হবে আর তাকে ঢেউ বলা যাবে না যা তীর ভাঙতে অক্ষম ৷ আবার স্মৃতি মুছে যেতে পারে,বিবর্ণ হতে পারে কিন্তু ভাঙতে পারে না ৷ আর যদিও ভাঙে তার ভাঁজ হয় না ৷ শব্দ প্রয়োগের দিক থেকে লাইনটি অর্থহীন ৷স্মৃতি ভিসিডি ডিস্কের মত ভাঙলে পুরো কবিতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে ৷

দ্বিতীয় স্তবকে


ঢেউ ভাঙে জল ভাঙে ভেঙে চলে জীবনের শান্তপুকুর
পাতা নড়ে পাতা ঝরে নড়ে ওঠে শান্তদুপুর
দেহ জুড়ে বয়ে যায় ঝড়ের কাঁপন
খেরোখাতা ছিড়ে যে ছিল আপন ৷

এই স্তবকের সারাংশ এই, স্থবির জীবনের আশাগুলো খন্ড খন্ড ভাঙনে যাত্রা শুরু করার পর মধ্যাহ্নে তার স্বপ্নগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে আর সেগুলো তার কোন আপনজনের চক্রান্তে ৷ 
কবি আবারও প্রথম বাক্যে একই ভুল করেছেন নিছক চিত্রকল্পের খাতিরে যা অবান্তর ৷ জল ভাঙে এবং ভাঙতে পারে আর শান্ত পুকুর গতিময়তা পেতে পারে কিন্তু ঢেউ ভাঙতে পারে না বরং হারাতে পারে ৷ এখানেও প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনে যতিবিভ্রম ঘটেছে যা পাঠকের কাছে কাম্য নয় ৷

তৃতীয় স্তবকে


হিংস্র নখর কতো ছিঁড়ে ফেলে হৃদয় নহর
দুপুরের ঝলকানি ঢেলে দেয় হিংসা বহর
দয়িতার স্বপনের চূড়া ভেঙে মনজিল শেষ
পিদিমেরা কেঁদে ওঠে হায় ফার্নেস ৷

এই স্তবকের সারাংশ এই,  জীবন মধ্যাহ্নে হিংসুক হিংস্র পশুর নখের আঘাতে তার হৃদয়ের স্বপ্নের মঞ্জিল ছিন্ন ভিন্ন আর তাই ছোট আশা গুলো পুনরুজ্জীবনের কাছে বিলাপ করে ৷ এই সারাংশ যে স্তবকে ফুটে ওঠেছে তা যে কবির কৃতিত্ব তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন কিনা তা আলোচ্য বিষয় ৷
হৃদয় নহর ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয় কেননা এটা খেরোখাতা নয় ৷ হৃদয় নহর বিদ্ধ হয়,জ্বলতে পারে,আন্দোলিত হতে পারে,ফেটে যেতে পারে,ভাগ হতে পারে কিন্তু ছিড়তে পারে না ৷ আবার কবি নিজের একান্তে কবিতা শুরু করলেও এখানে এসে প্রয়োগ করেছেন বহুজনের কাছে ৷ তার প্রথম প্রমাণ প্রথম লাইনে 'কতো'  শব্দে পাঠকের কাছে তা উন্মোচিত হয়েছে ৷ আবার দুপুরের ঝলকানি বলতে পুনরুজ্জীবনকে নির্দেশ করেছেন কিন্তু এমনভাবে প্রয়োগ করছেন যেন কবি নিজেই অন্যকে হিংসা করছেন ৷ তার প্রমাণ তৃতীয় লাইনে দয়িতা(নারী) শব্দে উন্মোচিত হয়েছে ৷ এখানে একজন নারী হিসেবেও কবি আত্নপ্রকাশ করেছেন আবার শত্রু হিসেবেও আত্নপ্রকাশ করেছেন যা বিরোধাভাস ৷ কবি এখানে ইঙ্গিত সূচক কোন বাক্য ব্যবহার করেন নি অস্পষ্টতা দুর করার জন্য ৷ দুপুরের ঝলকানিকে যদি ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করি তবে প্রথম লাইনটি অর্থহীন মনে হয় ৷ চতুর্থ লাইনে পিদিমেরা শব্দটি বহুবচন করে সংহত একটা ভাবকে আবারও বিতর্কিত করেছেন ৷চিত্রকল্পের খাতিরে পাঠকের কাছে সুক্ষ বিষয় অনুভূত হওয়ার কথা ন়য় বরং আবেগটা প্রাধান্য দিয়েছেন কবি ৷ এটা কবির নারীরূপ কল্পনা যা দয়িতা শব্দে দৃষ্টিগোচর হয়েছে ৷

চতুর্থ স্তবকেঃ


হুকা থেকে উড়ে আসে নিঃশেষ ধোঁয়া
হায় কেন সাধ হল খেরোখাতা ছোঁয়া

দুই লাইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হল হুকার ধোঁয়া নিঃশেয় হয়েছে অর্থাৎ জীবনের সায়াহ্নে আগমন আর কবির ভুল যে অন্যের খেরোখাতা ছুয়েঁ ফেলা ৷

'জীবনের খেরোখাতা' যে শুধু কবির একার খাতা নয় তার সাথে জড়িয়ে আছে মলাটবন্দী আরেক খাতা ৷ পরস্পর বিরোধের কারণে দুইজনই যে নিভু নিভু অর্থাৎ সংসারে আবদ্ধ তা পরস্পর বিরোধী ভাষ্যে উন্মোচিত হয়েছে ৷ একজন ছিঁড়ে ফেলে যন্ত্রনা দিয়েছে আর একজন ছুঁয়ে যন্ত্রনা পেয়েছে ৷ কবি হয়ত কল্পনা করতে পারেন নি  যে তিনি নিজেই শত্রুবেশে সংসারধর্মে নায়ক ৷ কবিতার ভাবগত দিকটা সম্পূর্ণ নতুন এর আগে এ রকম কবিতা লিখিত হয় নি ৷ মানুবজীবনের অগ্রযাত্রায় সংসার যে উপযাচক তাই কবির ভাষ্য ছিল এই কবিতায় ৷

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ছড়ার যাদুকর জগলুল হায়দার ও আধুনিক প্রেক্ষাপট—রায়ান নূর

ছড়ার নাম মুখে আনলেই সাম্প্রতিক কালে প্রথম যে নামটি মুখে আসে তা জগলুল হায়দার ৷আধুনিক কালে জগলুল হায়দার ছড়ার যাদুকর এবং বিজ্ঞান ছড়ার জনক হিসেবে পরিচিত৷ তাকে আধুনিক অনুকাব্যের পথিকৃত বলা হয়ে থাকে। তরুনদের মাঝে তো বটেই এমনকি দুই বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছেও জনপ্রিয় তিনি ৷ সাম্প্রতিক কালে তিনি নিজে একটা বলয় তৈরি করেছেন প্রজ্ঞা দ্বারা ৷তার ছড়ায় রয়েছে যেমন ছন্দের খেলা তেমনি ভাষাও সম্পূর্ন নতুন আঙ্গিকের ৷ ছড়াকার নিজ প্রয়োজনেই সম্পূর্ন নতুন ও উত্তরাধুনিক শব্দ দ্বারা তৈরি করেছেন নানান অন্ত্যমিল এককথায় ছড়াভাষা ৷ তিনি নব্বই দশকের একবারে শেষের দিক থেকে বিরতিহীনভাবে লিখে গেছেন ছড়া এবং এখনও লিখছেন ৷ প্রতিদিন চা এর কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টোলেই চোখে পড়ে তার ছড়া ৷ তিনি যেন উত্তরাধুনিক ছড়ার প্রবাদ পুরুষ ৷ ছড়াকার সুকুমার রায়,সুকুমার বড়ুয়া এদের বলয়ের বাইরে নিজ ছড়াভাষা প্রয়োগ করে ছড়ায় নতুনত্ব এনেছেন ৷

তিনি সকল ধরনের ছড়া লিখেছেন;রাজনৈতিক,ঐতি­হাসিক,ভালোবাসার ছড়া,লোকজ এমনকি বিজ্ঞান ছড়া লিখেছেন অঢেল ৷ তার ছড়া তত্ত্বে ভরপুর হলেও চমকদার পরিবেশনার কারণে পাঠকের কাছে তা ভারি ঠেকে না। ৷ ছড়ায় যে বিনোদনের মাধ্যমেই তত্ত্ব করা যায় আর তা যে পাঠকের মনের খোরাক মেটাতে পারে এটি একমাত্র তিনিই সফলভাবে প্রমাণ করেছেন ৷ এই পারদর্শিতায় তার ছড়ায় তত্ত্ব ছাপিয়ে বরং হাসিটা মুখ্য হয়ে ওঠে যেমন সুকুমার রায়ের ছড়াতেও দেখা যায় ৷

(1)

আজকে মারেন একে আবার

কালকে মারেন তাকে

এই যদি দেন কানে থাপড়

এই ঘুসি দেন নাকে।

(ছড়াঃ হচ্ছে কি সব )


হাসির ভেতর লুকিয়ে থাকে বিপুল রহস্য আর কলমের মারপ্যাচে রাজনীতিকে যে ছড়ার স্বল্প আয়তনের মধ্যে যে স্থান দেওয়া যায় এর উদাহরণ তার ছড়া ৷ রাজনীতির সুক্ষ অংশগুলো জনসাধারণের কাছে খুব সহজেই কর্ণগোচর করতে পেরেছেন ৷ বৈশ্বিক রাজনীতি,কুটনৈতিক চালচিত্র ও নানা বৈষয়িক প্রসঙ্গ নিয়ে ছড়া রচনা করেছেন তিনি৷ তার ছড়ায় মানবতাবোধ,ক্ষোভ,ভালো­বাসা,জনমানুষের আকাঙ্খা,প্রতিবাদ,ঘৃণা সব কিছু ফুটে ওঠেছে এবং বিবিধ দর্শনে হয়েছে বৈচিত্র্যময় ৷তার কলম একদিকে ভালোবাসাকে যেমন ধারণ করে অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদদের প্রতি প্রতিবাদের তীব্র ভাষাও উচ্চারণ করে ৷ তার এই প্রতিবাদের ধরণই তাকে মনেপ্রাণে উত্তরাধুনিক করে তুলেছে ৷

(2)

ছিটমহলের স্বপ্নগুলো মধ্যিখানে ফেঁসে

আশার তরী তীর পেলোনা আবার গেলো ভেসে; 

ভাল্লাগে না মমতা দি তোমার সাথে আড়ি

জল হারা সব ঢেউয়ের স্মৃতি পদ্মাতে খায় বাড়ি! 

মনমোহনের মনের খবর সোনিয়াজী জানে

পানি ছাড়া প্রাণ আসে না ভাটিয়ালী গানে;

পদ্মা তবু ধুঁকে মরে শুকনো বালু চরে

তিস্তা তিতাস লাইন দিলো সেই মরণের তরে। (ছড়াঃনিষ্ফলা)

(3)

ফেলানি সে মরলো আবার প্রথম মরণ বাদে

ভূভারতে বিবেক কোথায় ভাইবা এ মন কাঁদে।

পাক-চিনে তো হয় না এমন বছর বছর ধরে

কিন্তু দ্যাখো এই বর্ডারে রোজ বাঙালি মরে।

নরম পেয়ে গরম দ্যাখাও বর্ডার বিধির নামে

চীন দিলে তো দাবাড় আবার চান্দি তোমার ঘামে! 

বন্ধু তুমি কেমন বন্ধু বোঝার কি আর বাকি

নেয়ার বেলায় ষোলো আনা দেয়ার বেলায় ফাঁকি! 

মেক্সিকো তো বেশ আছে ভাই আমেরিকার পাশে 

রাশিয়া কি তাজাক-কাজাক কাওরে মারে ফাঁসে? (ছড়াঃ লানৎ)

(4)

বাংলাদেশের বুকের ওপর অ্যাংলো ভূতের মেলা

ঐতিহ্যের এই ভূমিতেই ভানুমতির খেলা?

মানবো এসব মুখ বুজে আর চুষবো আঙুল বসে 

ধন্য ধন্য বলবো সবাই হাতের তালু ঘসে?

(ছড়াঃ বাংলা ছাড়ো)


জগলুল হায়দারের ছড়া নিয়ে এ কথা বললে বেশি হবে না যে বর্তমানে এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় তার ছড়ার ছড়াছড়ি ৷ অসংখ্য ছড়ার বীজ বপন করে গেছেন তিনি ৷এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমালোচক কবি সাযযাদ কাদির বলছেন,"জগলুল হায়দার এত লেখেন। এত ভালোই বা লেখেন কী করে!"পেশা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার হলেও তিনি ছড়াকার ৷তার ছড়া বহুমাত্রিক এবং এ যুগের অন্যান্য ছড়াকারদের তুলনায় তিনি বেশি পারদর্শী ৷তার ছড়ার বহুমাত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায় নতুন স্লোগান,ছাগলশুমারী, দলীয়করণ, উল্টা নিয়ম, স্যাটেলাইট অপকালচার এর মত প্রায় কালজয়ী ছড়ায় ৷ ইতিহাস আজ লিখতে হয়না,ইতিহাস নিজেই লিখে রাখে যুগের ধারককে ৷ এবার অন্যান্য প্রসঙ্গে আসা যাক ৷তার ছড়া একটি বিশেষ সময়কে ধারণ করে তাতে থাকে ইতিহাস ও দেশের বিদ্যমান সংকট ৷তিনি সকল কিছুই ভাবেন নিভৃতে তাই প্রতীয়মান হয় ছড়ায় ৷তিনি যে শুধু ছড়াকার নন তিনি একজন নাগরিক এবং সেই নাগরিক ভাবনা রুচিও প্রাধান্য পেয়েছে তার ছড়ায় ৷ তার সমসাময়িকরা যখন অপেক্ষাকৃত সহজ ও বহুল কথিত গ্রামজীবন নিয়ে কাজ করেন তখন তিনি বেছে নেন তুলনামূলক জটিল ও অল্পকথিত নগরজীবন।

(5)

আমি তুমি তুমি আমি আখেরে এ দেশি তো

মিলেঝিলে পার করো ভোটে কাঁপা এ শীতও! (ছড়াঃসময়ের ধ্বনি)

(6)

গদির প্রেমে গদির প্রেমে

নানান কিন্তু যদির ফ্রেমে

ফাঁসলো আমার দেশ

ভিনদেশি সুর হাওয়ায় ভাসে

বিদেশ থেকে দাওয়াই আসে

টেনশনে চুল শেষ!

(ছড়াঃ পাওয়ার)

(7)

রাজনীতির আণ্ডা ফুঁড়ে

বাচ্চা তো আর ফুটছে না

নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে যায়

তাও অনেকেই উঠছে না।

( ছড়াঃগদির গান)


কোন সফল লেখকই গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না,তিনি ভ্রমন করেন বিশ্বপরিমন্ডলে মনোজগতে অথবা বস্তুজগতে ৷ জগলুল হায়দার এর ব্যতিক্রম তো ননই বরং অন্যদের থেকে এগিয়ে৷ বিষয়টি বাংলার ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে-' বাংলাদেশে বাস করেও বাংলাদেশের হয়েও জগলুল সারা পৃথিবীকে আপন করে দেখেন, নিজের বলে ভাবেন। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সংকট সমস্যায় সরব হন যেন তিনি যথার্থ বিশ্বনাগরিক।'

তিনি বিশ্বসাহিত্যের সংস্পর্শে এসে নিজের ছড়াকে করেছেন সমৃদ্ধ ৷তিনি যে শুধু নিজেই ছড়া লিখেছেন তা নয় ৷ তিনি অনুবাদ করেছেন অনেক নিজের ভাষায় যেমন উইলিয়াম ব্ল্যাক এর লেখা ৷

Eternity

William blake


He who binds himself a joy

Does the winged life destroy;

He who kisses the joy as it flies

Lives in eternity's sunrise.


জগলুল হায়দার অনূদিত


যে বাঁধে আনন্দ স্বর্গে আপনাকে

অনায়াসে পারে নিতে দহনের তাপ নাকে;

ডানা কেটে পতপত ওড়া যার সম্ভব খুব

অনন্ত সূর্যে সেই আঁকে চুমো অপরূপ ৷


ছড়ার যেমন সীমা নেই লেখার তেমনি শেষ নেই ৷ ছড়াসাহিত্য বাংলাভাষার ভিত্তিস্বরুপ যা বহুকাল ধরে জনমানুষের মুখে চালিত ৷ কতিপয় সাহিত্যানুরাগীদের প্রতিভায় থাকে এর বিপূল অগ্রযাত্রা ৷ সাহিত্যরস বিচারে কখনো ছড়ার মূল্যায়ন হয় না বলে অতীতে পণ্ডিতরা বলে গেছেন। বরং বলেছেন ছড়ায় হাস্যরসের প্রাধাণ্য বেশি৷ তারপরও সেই সাহিত্যগুন বিচারেও তার ছড়া যেন উৎড়ে যায় সুখকর অনুভবে৷ আর বিষয় চিন্তা দর্শনের মাপকাঠিতে উত্তরাধুনিক এই বিশ্বায়নের যুগে জগলুল হায়দার সূর্য স্বরুপ ৷ আমাদের ছড়ার নতুন বাতিঘর ৷



রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলা চর্যাপদ

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ॥
চর্যা-১
লুইপা
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥ ধ্রু॥
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥ ধ্রু॥
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই॥ ধ্রু॥
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিতি লেহু রে পাস॥ ধ্রু॥
ভণই লুই আম্হে ঝানে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা॥ ধ্রু॥

অর্থঃ
শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল–
চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল।
দৃঢ় ক’রে মন মহাসুখ পাও,হ
কী-উপায়ে পাবে গুরুকে শুধাও।
যে সবসময় তপস্যা করে
দুঃখে ও সুখে সেও তো মরে।
ফেলে দাও পারিপাট্যের ভার,
পাখা ভর করো শূন্যতার–
লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান
দেখেছি, লভেছি দিব্যজ্ঞান।
চর্যা-২
কুক্কুরী
কাছিম দুইয়ে উপচে পড়ে ভাঁড়,
গাছের তেঁতুল কুমিরের খাবার,
ভেদ নাই আর ঘরে-আঙিনাতে,
কানেট চোরে নিল অর্ধরাতে–
শ্বশুর ঘুমে, বধূ একা জাগে,
কানের কানেট কার
কাছে সে মাগে?
দিনে বধূ কাকের ডরে কাঁপে,
রাতদুপুরে সে-ই ছোটে কামরূপে!
কুক্কুরীপার চর্যা এমনই যে
কোটির মাঝে একজন তা বোঝে।
চর্যা-৩
বিরূপা
এক সে শুঁড়িনি, ঢোকে দুইখানি ঘরে,
চিকন বাকলে মদ্য ধারণ করে।
সহজে এ-মদ চোলাই করো রে, তবে
অজর অমর দৃঢ়স্কন্ধ হবে।
দশমীর দ্বারে ছদ্ম আমন্ত্রণ
দেখে, খদ্দের সেদিকে ধাবিত হ’ন–
পসরা সাজানো চৌষট্টি ঘড়ার,
খদ্দের ঢুকে বা’র হয় না রে আর।
একটাই ঘড়া, অতি-সরু মুখ তায়–
বিরু বলে,
ঢালো ধীরে ধীরে ঘড়াটায়।
চর্যা-৪
গুণ্ডরী
জঘনের চাপে, যোগিনী, আলিঙ্গন দে!
দিন কেটে যাক পদ্ম-বজ্র-বন্ধে।
মুখ-ভরা তোর কমলের রস, চুমুর চুমুকে খাব।
একমুহূর্ত না যদি থাকিস তাহলেই
ম’রে যাব।
খেপে গেছি আমি, যোগিনী আমার,
মেয়ে,
ঊর্ধ্বলোকেই করেছি যাত্রা মণিমূল
বেয়ে বেয়ে–
শাশুড়ির ঘরে তালাচাবি হ’ল আঁটা
চাঁদ-সূর্যের দু’পাখা পড়ল কাটা।
গুণ্ডরী বলে, আমি সুরতের হেতু
নর-নারী-মাঝে ওড়ালাম কামকেতু।
চর্যা-৫
চাটিল
ভবনদী বয় বেগে গহিন গভীর,
মাঝগাঙে ঠাঁই নাই, পঙ্কিল দু’তীর–
চাটিল ধর্মের জন্য সাঁকো গড়ে তায়,
পারগামী লোক তাতে পার হ’য়ে যায়।
অদ্বয়-কুঠারে চিরে মোহতরু, তার
তক্তা জুড়ে নির্বাণের সাঁকো হ’ল
দাঁড়।
চেয়ো না ডাইনে বাঁয়ে এ-সাঁকোয়
চ’ড়ে,
দূরে নয়, বোধি আছে নিকটেই ওরে।
কীভাবে ওপারে যাবে,
যারা যেতে চাও,
অনুত্তর স্বামী গুরু চাটিলে শুধাও।
চর্যা-৬
ভুসুকু
কারে করি গ্রহণ আমি, কারেই
ছেড়ে দেই?
হাঁক পড়েছে আমায় ঘিরে আমার
চৌদিকেই।
হরিণ নিজের শত্রু হ’ল মাংস-হেতু তারই,
ক্ষণকালের জন্য
তারে ছাড়ে না শিকারী।
দুঃখী হরিণ খায় না সে ঘাস, পান
করে না পানি,
জানে না যে কোথায় আছে তার
হরিণী রানি।
হরিণী কয়, হরিণ, আমার একটা কথা মান্
তো,
চিরদিনের জন্য এ-বন ছেড়ে যা তুই,
ভ্রান্ত!
ছুটন্ত সেই হরিণের আর যায়
না দেখা খুর–
ভুসুকুর এই তত্ত্ব মূঢ়ের বুঝতে অনেক দূর।
চর্যা-৭
কানু
আলিতে কালিতে পথ আটকায়,
তাই দেখে কানু বিমনাঃ, হায়!
কানু বলে, কই করব রে বাস?
যারা মন জানে তারা উদাস।
তিন জন তারা, তারা যে ভিন্ন,
কানু বলে, তারা ভবচ্ছিন্ন।
এই আসে তারা, এই হয় হাওয়া
বিমনাঃ কানু এ’ আসা ও যাওয়ায়।
নিকটেই জিনপুর: কীভাবে
মোহান্ধ কানু সেখানে পালাবে?
চর্যা-৮
কম্বলাম্বর
করুণা-নৌকা পূর্ণ সোনায়,
রুপা রাখবার জায়গা কোথায়?
যাও রে, কামলি, আকাশের দেশে–
জন্ম গেলে কি আর ফিরবে সে?
খুঁটি উপড়িয়ে, কাছি খুলে শেষে,
বাও রে, কামলি, গুরু-উপদেশে।
গলুইতে চ’ড়ে চৌদিকে চাও,
হাল তো নাই, কে বাইবে এ-নাও?
বাঁয়ে আর ডানে চেপে চেপে গেলে
ঠিক পথ পেয়ে মহাসুখ মেলে।
চর্যা-৯
কানু
উপ্ড়ে কালের শক্ত খুঁটি
বিবিধ ব্যাপক বাঁধন টুটে
সহজ-নলিনীকুঞ্জে ঢুকে
মাতাল কানাই তৃপ্ত, সুখে।
হাতির যে-প্রেম হাতিনির তরে
তথতা সে-মদ বর্ষণ করে,
ষড়্গতি স্বস্বভাবে শুদ্ধ,
ভাবাভাবে কিছু নয় বিরুদ্ধ–
দশ দিকে রেখে দশ রতন
বিদ্যা-করীকে করি দমন।
চর্যা-১০
কানু
লো ডোমনি, তোর নগর-বাইরে ঘর,
নেড়া বামুন আমায় স্পর্শ কর্!
আ লো ডোমনি,
তোরে আমি সাঙ্গা করব ঠিক,
জাত বাছে না কানু, সে যে নগ্ন
কাপালিক।
একখানি সে পদ্ম,
তাতে চৌষট্টিটা পাপড়ি,
তার উপরে ডোমনি নাচে, কী নৃত্য
তার, বাপ রে!
ডোমনি, তোরে প্রশ্ন করি,
সত্যি ক’রে বল্,
কার নায়ে তুই এপার-ওপার করিস
চলাচল?
আমার কাছে বিক্রি করিস
চাঙাড়ি আর তাঁত,
নটের পেটরা, তোর জন্যেই, দিই
না তাতে হাত।
তোর জন্যেই, হ্যাঁ লো ডোমনি, তোর
জন্যেই যে
এই কাপালিক হাড়ের মালা গলায়
পরেছে।
পুকুর খুঁড়ে মৃণাল-সুধা করিস
ডোমনি পান–
ডোমনি, তোরে মারব আমি, নেব
রে তোর প্রাণ!
চর্যা-১১
কানু
দৃঢ়করে ধরা নাড়ির তরু
বাজে অনাহত বীর-ডমরু
কানু যোগাচার সাধন করে,
একাকার ঘোরে দেহ-নগরে।
আলি-কালি পায়ে নূপুর ক’রে
সূর্য-চাঁদের মাকড়ি প’রে
ষড়্রিপু ক’রে ভস্মসার
পরে সে মোক্ষমুক্তাহার।
মেরে সে শাশুড়ি ননদ শালি
এবং মায়াকে, কানু কাপালিক।
চর্যা-১২
কানু
খেলতে ব’সে দাবা করুণা-পিঁড়ায়
জিতেছি ভববল গুরুর কৃপায়:
রাজাকে আটকাই দুইমুখা চালে,
সামনে জিনপুর তাই তো কপালে।
প্রথমে গজ চেলে বড়েগুলি, আর
পাঁচটি আরও ঘুঁটি খেয়ে ফেলি তার,
মন্ত্রী দিয়ে শেষে রাজাকেই খাই,
কিস্তিমাত ক’রে ভববল পাই–
ভালোই দান চালি, কানু বলে এই,
চৌষট্টিটা ছঁক গুনে গুনে নেই।
চর্যা-১৩
কানু
ত্রিশরণ-নায়ে, আট কামরায়
এ-দেহ ভাসিয়ে দেখি
আমারই আপন দেহে মিলে যায়
শূন্য-করুণা, এ কী!
স্বপ্ন ও মায়া জেনে এ-জীবন,
ভবনদী তরলাম,
মাঝগাঙে এক ঢেউয়ের মতন
অনুভব করলাম।
পাঁচ তথাগতে দাঁড় ক’রে দেহ-নায়ে
কানু পার্থিব মায়াজাল ত’রে যায়।
গন্ধ রস ও স্পর্শ থাকুক
নিদ্রাবিহীন স্বপ্নের মতো,
শূন্যে, মনেরে মাঝি ক’রে, সুখ–
সঙ্গমে কানু হ’ল নির্গত।
চর্যা-১৪
ডোমনি
পারাপারের নৌকা চলে গঙ্গা-
যমুনায়,
মাতঙ্গিনী, যোগীকে পার করে সে-
খেয়ায়।
সাঁঝ ঘনাল, বাও রে, ডোমনি,
জোরসে চালাও না’,
গুরুর কৃপায় জিনপুরে ফের রাখব আমার
পা।
পাঁচটি বৈঠা পাছ-গলুইয়ে, পিঁড়ায়
বাঁধা দড়ি,
আকাশ-
সেঁউতি দিয়ে নৌকা সেচো পড়িমরি।
সূর্য-চাঁদের লাটাই-দু’টি গোটায়
এবং খোলে,
ডাইনে বাঁয়ে পথ নাই রে, যাও বরাবর
চ’লে!
পয়সাকড়ি নেয় না ডোমনি, স্বেচ্ছায়
পার করে;
বাইতে যে-জন জানে না,
সে ঘুরে ঘুরে মরে।
চর্যা-১৫
শান্তি
স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে
অলখ হয় না লক্ষণ;
সোজা পথে গেল যে-যে, আর হয়
না রে
তাদের প্রত্যাবর্তন!
কূলে-কূলে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ো না, মূঢ়,
সোজা পথ এই সংসার–
ভুল পথে তিলার্ধ না যেন রে ঘুরো,
কানাত-মোড়ানো রাজ-দ্বার।
মোহের মায়ার এই মহাসিন্ধুর
না-বুঝিস কূল আর থৈ,
নাও নাই, ভেলা নাই, দেখ যত দূর,
নাথে না শুধাও, পাবে কই।
শূন্য এ পাথারের পরিসীমা নেই,
তথাপি রেখো না মনে দ্বিধা–
অষ্টসিদ্ধিলাভ হবে এখানেই
হামেশা চলিস যদি সিধা।
শান্তি বলেন, বৃথা মরিস না খুঁজে,
তাকাস নে বামে দক্ষিণে;
সোজা পথে অবিরত চল্ চোখ বুজে,
সহজিয়া পথ নে রে চিনে।
চর্যা-১৬
মহীধর
তিনটি পাটে কৃষ্ণ হাতির অশান্ত
বৃংহণ,
শুনে, বিষয়-সমেত ভীষণ ‘মার’-এর
আন্দোলন;
মত্ত গজেশ ছুটে গিয়ে শেষটায়
গগন-প্রান্ত ঘুলিয়ে ফ্যালে তেষ্টায়;
পাপপুণ্যের শক্ত শিকলটি এ
ছিঁড়ে ফেলে, স্তম্ভটি উপড়িয়ে,
গগন-চূড়ায় নির্বাণে মন প্রবেশ করল
গিয়ে।
মন মহারস-পানে মত্ত হয়,
তিনটি ভুবন উপেক্ষিত রয়,
পাঁচ বিষয়ের নায়কের যে শত্রু কেউ নয়!
খররবিকিরণে মন গগন-গাঙে সাঁতরায়–
ডুবলে কিছুই যায় না দেখা!–
মহীধরে কাতরায়।
চর্যা-১৭
বীণা
সূর্য হ’ল লাউ আর তার হ’ল চন্দ্র,
অবধূতি চাকি হ’ল, অনাহত দণ্ড;
হেরুক-বীণাটি বেজে ওঠে, সখী ও
লো,
করুণায় শূন্য-তন্ত্রী বিলসিত হ’ল–
আলি-কালি দুই সুর হ’ল তাতে বন্দি,
গজবর, সমরস বীণাটির সন্ধি।
করতলে করপার্শ্ব চাপ দিলে পরে
বত্রিশ তন্ত্রীতে সব পরিব্যাপ্ত করে–
বজ্রাচার্য নৃত্য করে, দেবী ধরে গান,
বুদ্ধনাটকের তবে হয় অবসান।
চর্যা-১৮
কানু
পার ক’রে দেই তিনটি ভুবন অবহেলায়
সুপ্ত থেকে মহাসুখের মহালীলায়।
ডোমনি রে, তোর ভাবকালির পাই
না কোনো ঠিক,
পিছনে তোর কুলীনজন,
সঙ্গে কাপালিক!
বিচলিত করলি, ডোমনি, সবকিছুকেই,
চাঁদটিকে তোর টলিয়ে দেওয়ার কারণ
তো নেই!
বিরূপা কয় কুলোকে যদিও তোরে,
জ্ঞানী জনে রাখে গলায়
মালা ক’রে।
কানু বলে, কামাতুরা রে চণ্ডালী,
তিনভুবনে তুলনাহীন তোর ছিনালি!
চর্যা-১৯
কানু
ভব নির্বাণ, পটহ মাদল;
মন ও পবন, কাঁসি আর ঢোল;
দুন্দুভি বাজে জয়-জয়-রবে,
কানু-ডোমনির আজ বিয়ে হবে।
ডোমনিকে বিয়ে ক’রে জাত গেল,
শ্রেষ্ঠ ধর্ম যৌতুক পেল;
কাটে নিশিদিন সুরত-রঙ্গে,
রজনি পোহায় যোগিনী-সঙ্গে–
যে-যোগী মজেছে ডোমনির পাঁকে
প্রাণ গেলে তবু ছাড়ে না সে তাকে।
চর্যা-২০
কুক্কুরী
হলাম নিরাশ, স্বামী ক্ষপণক, হায়,
আমার বেদনা ভাষায় কওয়া না যায়।
বিয়ালাম গো মা, আঁতুড়ের খোঁজ
নাই,
নাই কোনোকিছু, এখানে যা-কিছু চাই।
প্রথম প্রসব আমার, বাসনাপুট,
নাড়িটা কাটতে-কাটতেই, হ’ল ঝুঁট!
পূর্ণ আমার হ’ল নবযৌবন,
ঘটল মায়ের বাপের উৎসাদন।
কুক্কুরী ভনে, এ-জগৎ চির-স্থির,
যে জানে এখানে, সে-ই শুধু হয় বীর।
চর্যা-২১
ভুসুকু
গভীর নিশীথে এখানে ওখানে চ’রে
অমৃতভক্ষ মূষিক আহার করে–
বায়ুরূপী ঐ মূষিকেরে, যোগিবর,
আনাগোনা-রোধকল্পে, ঘায়েল কর্।
চপল মূষিক, মাটি খুঁড়ে থাকে গর্তে,
জেনে তার ঠাঁই, ধাও তাকে বধ করতে।
কৃষ্ণ মূষিক, আঁধারে সে অগোচর,
আনমনা ধ্যানে হ’য়ে যায় সে খেচর,
উড়াম-বা’রাম অস্থির সে-মূষিক
যতখন গুরু না-দেখান তাকে দিক্।
ভুসুকু ভনয়: বিচরণ শেষ হ’লে
সেই মূষিকের সব বন্ধন খোলে।
চর্যা-২২
সরহ
নিজ মনখানি বেঁধে ভবনির্বাণে
মিথ্যাই লোক ফেরে তার সন্ধানে–
অচিন্তনীয় কিছুই জানি না, মন,
কীরূপে জন্ম, কীরূপে হয় মরণ।
জীবনে-মরণে নাই কোনো বিচ্ছেদ,
জীবিতে ও মৃতে নাই রে কোনোই
ভেদ।
জন্ম-মৃত্যু-ভয়ে ভরা যার বাসা
সে ক’রে মরুক রসরসায়ন আশা;
ত্রিদশে ভ্রমণ করে যে সচরাচর
কীভাবে কভু-বা হবে সে অজরামর?
কর্মে জন্ম, নাকি সে জন্মে কর্ম?
সরহ বলেন, বড়ই ঘোরালো ধর্ম!
চর্যা-২৩
ভুসুকু
ভুসুকু, তুমি শিকারে গেলে,
মারবে পাঁচ জনে,
একাগ্রতা নিয়ে তখন যেয়ো পদ্মবনে।
বিহানে যারা জিন্দা,
রাতে তারা মৃত্যুলোকে,
শিকার-বিনা মাংস পেতে ভুসুকু
বনে ঢোকে।
মায়াজালের ফাঁদেই মায়া-হরিণ
পড়ে মারা–
তারাই বোঝে, সদ্গুরুকে জিগেশ
করে যারা।
চর্যা-২৬
শান্তি
তুলা ধুনে ধুনে পাওয়া গেল আঁশ,
আঁশ ধুনে ধুনে আর কিছু নেই,
বোঝা তো গেল না কী যে হেতু
তার–
শান্তি বলেন–ভাবো যেভাবেই।
তুলা ধুনে ধুনে খেলাম শূন্যতাকে,
পরে তো হলাম শূন্য নিজেই।
কাদা-ভরা পথ, দু’বার যায় না দেখা,
চুলেরও ঢোকার সামর্থ্য নেই।
কার্য কারণ কিছু নয়, কিছু নয়,
স্বয়ং-সংবেদন এ, শান্তি কয়।
চর্যা-২৭
ভুসুকু
আধেক রাতভর পদ্ম ফোটে রাশি-রাশি,
হ’ল রে বত্রিশ যোগিনী-দেহ উল্লাসী।
চাঁদটা পার হ’য়ে যায় রে অবধূতি-সেতু,
রত্ন গুণে হয় সহজ চির-প্রকাশিত।
নির্বাণের খালে চালানো হ’ল
শশধরে,
মৃণালে সরোবর পদ্ম যেরকম ধরে।
বিরমানন্দ যে বিলক্ষণ পরিশুদ্ধ
যে বোঝে এইখানে, কেবল সে-ই হয় বুদ্ধ।
ভুসুকু বলে তবে, পেয়েছি তার
সাথে মিলে
সহজানন্দের নিত্য মহাসুখ-লীলে!
চর্যা-২৮
শবর
উঁচু পর্বতে বাস করে এক শবরী বালা,
ময়ূরপুচ্ছ পরনে, গলায় গুঞ্জামালা।
মত্ত শবর, পাগল শবর, কোরো না গোল,
সহজিয়া এই ঘরনিকে নিয়ে দুঃখ ভোল্।
নানা গাছপালা,
ডালপালা ঠ্যাকে আকাশ-তলে;
একেলা শবরী কুণ্ডলধারী বনস্থলে।
ত্রিধাতুর খাটে শবর-ভুজগ শেজ বিছায়,
নৈরামনির কণ্ঠ জড়িয়ে রাত পোহায়,
কর্পূরযোগে হৃৎ-তাম্বূল চিবায় সুখে,
আত্মাহীনার আসঙ্গ তার মত্ত বুকে–
গুরুবাক্যের ধনুকের তিরে আপন মন
গেঁথে ফেলে লভো পরিনির্বাণ, পরম
ধন।
কোথায় লুকালে, শবর আমার, অন্ধকারে?
খুঁজব তোমাকে কোন্ গিরিখাতে,
কোন্ পাহাড়ে?
চর্যা-২৯
লুই
ভাব-ও হয় না, না-যায় অভাবও,
এমন তত্ত্বে কী-বা জ্ঞান পাব?
লুই বলে, বোঝা ভীষণ কষ্ট,
ত্রিধাতু-বিলাসে হয় না স্পষ্ট।
যা-কিছু অরূপ, যা অতীন্দ্রিয়
আগম-বেদে কি তা ব্যাখ্যনীয়?
কী জবাব দেব–জলে বিম্বিত
চাঁদ সে সত্য, নাকি কল্পিত?
লুই বলে, কোনো কিছু নাই জানা,
কই আছি, নাই তারই যে ঠিকানা।
চর্যা-৩০
ভুসুকু
করুণার কালো মেঘ নিরন্তর ফুঁড়ে
ভাব-অভাবের দ্বন্দ্ব যায় ভেঙেচুরে।
আকাশে উদিত এক অতি-অপরুপ!
দ্যাখো রে, ভুসুকু, তার সহজ স্বরূপ।
ইন্দ্রিয়ের জাল টুটে যাবে,
জানো যদি,–
মনের গহনে পাবে উল্লাসের নদী।
আনন্দ লভেছি বুঝে বিষয়-বিশুদ্ধি,
চাঁদের আলোর মতো বিকশিত বুদ্ধি;
এ-আলোকই ত্রিলোকের একমাত্র সার–
কেটে গেছে ভুসুকুর মনের আঁধার।
চর্যা-৩১
আর্যদেব
কী জানি কেমন ঘরে ঢুকলুম,
ইন্দ্রিয়-মন হ’য়ে গেল গুম।
করুণা-ডমরু শুধু বেজে যায়,
আর্যদেবের ঠাঁই নিরালায়।
অসংবেদনে ট’লে ঢোকে মন
চন্দ্রকান্তি চন্দ্রে যেমন–
দূর ক’রে ভয়, ঘৃণা, লোকাচার
চেয়ে চেয়ে দেখি শূন্য-বিকার।
ছেড়ে দিয়ে লোকলজ্জা সকল
আর্যদেবের সকলই বিকল।
চর্যা-৩২
সরহ
নাদ নয়, আর বিন্দুও না, সূর্য-চন্দ্র নয়,
চিত্তরাজা স্বস্বভাবে বাঁধন-মুক্ত হয়।
সোজা পথটা সামনে রেখে ধরিস
না পথ বাঁকা,
লঙ্কা যা’স না, এই তো বোধি, নিজের
মধ্যে ঢাকা!
আয়না নে’য়ার দরকার নাই কাঁকন-
পরা হাতে,
নিজের মন না-বুঝলে নিজে, কী আর
হবে তাতে?
ওগো যোগী, যাবে যদি ভবনদীর পার,
দুর্জনেরে সঙ্গে নিলে পার
পাবে না আর।
ডাইনে-
বাঁয়ে ভ’রে আছে নালা ডোবা খাল,
সরহ কয়, বাপু, তোমার
সোজা রেখো হাল।
চর্যা-৩৩
ঢেণ্ঢন
টোলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নাই;
অন্নহীন, নাই তবু ইষ্টির কামাই!
ব্যাঙ কি কামড় মারে সাপের শরীরে?
অথবা দোয়ানো দুধ বাঁটে যায় ফিরে?
বলদে বিয়ায় আর গাভি হয় বন্ধ্যা,
পিঁড়ায় দোয়ানো হয় তাকে তিন
সন্ধ্যা–
যে জ্ঞানী সবার চেয়ে, অজ্ঞান
সে ঘোর;
সবার চেয়ে যে সাধু, সেই ব্যাটা চোর!
শিয়াল-সিংহের যুদ্ধ চলে অনুক্ষণ–
লোকেরা বোঝে না, তাও বলেন
ঢেণ্ঢন।
চর্যা-৩৪
দারিক
শূন্য-করুণা, কায়-বাক্-চিৎ, এই
অভিন্নাচারে
বিলাসে দারিক মত্ত হলেন আকাশের
পরপারে।
অলক্ষ্যকেই বিলোকন ক’রে, মহাসুখ-
অভিসারে
বিলাসে দারিক মত্ত হলেন আকাশের
পরপারে।
কী তোর মন্ত্রে, কী তোর তন্ত্রে,
কী ধ্যান-ব্যাখ্যানেই?
অপ্রতিষ্ঠ মহাসুখ যদি, নির্বাণ
তবে নেই।
দুঃখ ও সুখ সম জ্ঞান ক’রে, ইন্দ্রিয়-
উপভোগ,
আপন-পরের ভেদ ভুলে যেতে, দারিক
করেন যোগ।
রাজা রাজা রাজা, আছে যত রাজা,
সবাই ফক্কিকার–
দ্বাদশ দেশের রাজা এ-দারিক, লুইপাদ
গুরু যার।
চর্যা-৩৫
ভদ্র
এতকাল আমি ছিলাম অন্ধ
স্বমোহাবেশে,
সদ্গুরু রোগ সারিয়ে দিলেন সদুপদেশে।
এতকাল মন নিমগ্ন ছিল মনের তলে,
আকাশ যেমন ঢ’লে প’ড়ে যায়
সাগরজলে।
দশ দিকে ছিল মহাশূন্যের মহা-আঁধার,
এ-মনে ছিল না পাপপুণ্যের
কোনো বাধা।
বজ্র আমাকে খাওয়াল
সে শেষে মোক্ষফল,
মহাতৃপ্তিতে পান করলাম আকাশজল–
ভাদে বলে,
আমি ভাগ্যকে দিয়ে জলাঞ্জলি
নিজ মন খেয়ে, সুখদুঃখের ঊর্ধ্বে চলি।
চর্যা-৩৬
কানু
তথতার মারে শূন্য বাসনা-আগার,
উজাড় করেছি সব মোহের ভাঁড়ার;
বেঘোর সহজ নিদে উলঙ্গ কানাই,
এই ঘুমে আত্ম-পর ভেদাভেদ নাই,
চেতনা-বেদনা নাই–খুলে আবরণ
সুখময় ঘুমে কানু হ’ল অচেতন।
স্বপনে হেরিনু আমি, শূন্য ত্রিভুবন
গমনাগমনহীন ঘানির মতন–
সাক্ষী জালন্ধরীপাদ–কারণ, আমায়
পণ্ডিতে চেনে না পাশমুক্ত অবস্থায়।
চর্যা-৩৭
তাড়ক
আমিই যদি আমাতে নেই, কীসের
তবে ভয়?
মহামুদ্রা লাভের আশা আমার জন্য নয়।
সহজেরে বোঝ্ রে, যোগী, ভুলিস
না রে ভবী,
চতুষ্কোটি মুক্ত যেমন, তেম্নি মুক্ত হবি।
যেরকম ইচ্ছা হবে সেরকমই থাকো,
সহজিয়া পথটাকে ভুলে যেয়ো না কো;
মেঢ্র ও অণ্ডের ক্রিয়া জাহের,
সাঁতারে,
বাতেনি যা, বুঝি কোন্ তরিকায়
তারে?
তাড়ক বলেন, বড় গুরু সমস্যাটা,
যারা বোঝে, তাদের গলায় ফাঁস
আঁটা।
চর্যা-৩৮
সরহ
দেহরূপ নায়ে বৈঠা মন,
হাল ধরো সদ্গুরুর বচন,
মন স্থির ক’রে ব’সো গো নায়ে,
পারে যাওয়া নাই অন্য উপায়ে।
সহজে নৌকা গুণ টেনে নাও,
হে মাঝি, যেয়ো না আর-কোথাও।
পথে পথে আছে ডাকাতের ভয়,
ভব-দরিয়ার ঢেউয়ে, বিলয়।
কূল ধ’রে, স্রোতে বাইলে উজানে
নৌকা ঢুকবে সোজা আসমানে।
চর্যা-৩৯
সরহ
মন রে, আমার স্বপ্নেও তুই হায়
আপন দোষে আছিস অবিদ্যায়!
মন, কী ক’রে আর গুরুবচন–
বিহারে তুই করবি পর্যটন?
গগনকোণে আজব হুহুঙ্কার–
বঙ্গে জায়া নিয়ে গেলি, আর
বিজ্ঞান তোর হ’ল যে মিসমার!
অদ্ভুত এই ভবের মোহে, মন,
পরকেও তুই দেখিস রে আপন–
জগৎ যেন জলের মুকুর, আত্মা
সহজে হয় শূন্য ও লাপাত্তা।
চিত্ত আমার, নিত্য পরবশ,
বিষ গিলেছিস ফেলে সুধারস।
ঘরে-বাইরে কে আছে কে জানে,
দুষ্ট কুটুম দুঃখ শুধু হানে,
ইচ্ছা লাগে মারতে তাদের প্রাণে–
দুষ্ট বলদ থাকার চেয়ে তবে
শূন্য গোয়াল অনেক ভালো হবে!
একলা থাকি সুখে ও স্বচ্ছন্দে,
জগৎ দূরে যাক–সরহ বন্দে।
চর্যা-৪০
কানু
মনোগোচর যা, তা-ই ধোঁকা,
আগমপুথি, তসবিমালা।
অতীন্দ্রিয় সহজ আমি
ব্যাখ্যা করি কোন্ ভাষাতে?
বৃথাই, গুরু, শিষ্যটিকে
মাথামুণ্ডু চাও বোঝাতে,
কথায় বাড়ে প্রমাদ শুধু–
গুরু সে বোবা, শিষ্য কালা!
কানু বলেন, সহজ এই:
বোবায় বোঝে, বললে কালা।
চর্যা-৪১
ভুসুকু
এ-জগৎ অনুৎপন্ন আদিতে,
ভ্রান্তিতে প্রতিভাত।
রজ্জুকে যে সর্প
ভাবে তাকে কি কামড়ায় চন্দ্রবোড়া?
অদ্ভুত হে যোগী,
মিছা কোরো না তোমার হাত নোনা,
বাসনা টুটবেই, যদি জগতের
রীতি বুঝতে পারো।
যেন, মরু-মরীচিকা, গন্ধর্বনগরী, মুকুরের
প্রতিবিম্ব, বাত্যাবর্তে ঘন হ’য়ে শিল-
হওয়া জল,
যেন বহুবিধ খেলা খেলে চলে বন্ধ্যার
দুলাল–
খেলে খরগোশের শিং, বালুতেল,
আকাশকুসুমে–
রাজপুত্র ভুসুকুপা বলে, সব এরকমই বটে,
গুরুর শরণ নাও, যে এখনও আছো ভ্রান্ত
পথে।
চর্যা-৪২
কানু
শূন্যে পূর্ণ চিত্ত সহজে,
কাঁধ ভেঙে গেলে দুঃখ নেই;
কানু ম’রে গেছে, তোমরা কহ যে–
সে আছে ত্রিলোকে সবখানেই।
দৃশ্যলোপে যে বুক-দুরুদুরু,
ঢেউ কি কখনও শোষে সাগর?
দেখে না চক্ষু-বিহীন মূঢ়
দুধে-মিশে-থাকা দুধের সর।
আসে না যায় না কেউ এ-ঠাঁই,
এই বুঝে কানু আছে তোফাই।
চর্যা-৪৩
ভুসুকু
ফোটে সহজিয়া মহাতরু ত্রৈলোক্যে।
শূন্য-স্বভাবে বন্ধনহীন নয় কে?
সমরসে মনোরত্ন আকাশে মেশে,
পানিতে যেমন
পানি মেশে নিঃশেষে।
পর নাই তার, যার কেউ নাই আপনা;
জন্ম হয় নি যার, সে কখনও মরে না।
ভুসুকু বলেন, প্রকৃতির রীতি এই:
আনাগোনা আর
ভাবাভাবে স্থিতি নেই।
চর্যা-৪৪
কঙ্কণ
শূন্যে শূন্য মিললে তবে
সকল ধর্ম উদিত হবে।
অনুখন আছি এ-সংবোধে:
বোধির বিততি মাঝ-নিরোধে।
বিন্দু-নাদ না-ঢোকে হিয়ায়,
একটি চাইলে আরটি যায়!
কোত্থেকে এলে, সেইটে জানো,
মাঝখানে থেকে আঘাত হানো।
ভনে কলকল কাঁকনপাদে,
সবকিছু বুঁদ তথতা-নাদে।
চর্যা-৪৫
কানু
পঞ্চেন্দ্রিয় শাখা মন-তরুটাতে,
আশারূপ ফল পাতা শোভা পায় তাতে।
সদ্গুরু কাটে তরু বচন-কুড়ালে;
কানু বলে, এ-জীবন পাবে না, ফুরালে।
সেই তরু বাড়ে পাপপুণ্যের জলে,
বিদ্বান্ কাটে তারে গুরু-কৃপা-বলে।
তরুটার ছেদ-ভেদ না-জানে যে-বোকা
পৃথিবী সত্য ভেবে খায়
সে যে ধোঁকা।
শূন্য সে-তরুবর, আকাশ কুড়াল–
শিকড়ে বসাও কোপ,
ছেঁটো না রে ডাল।
চর্যা-৪৬
জয়নন্দী
স্বপ্ন যেমন বহু অদেখা দেখায়
অন্তরে সংসার তেম্নি যে হায়!
শেষ হ’লে হৃদয়ের মোহজাল বোনা
থেমে যায় মন-পথে যত আনাগোনা।
না সে পোড়ে, না সে ভেজে,
ছিঁড়েও না মন,
দ্যাখো মায়া-মোহে তার দৃঢ় বন্ধন।
ছায়া-মায়া-কায়া এরা সমান সবাই,
নানা শোভা ধরে তার উভয় পাখাই।
তথতা-সাধনে করো শুদ্ধ হৃদয়,
আর পথ নাই–জয়নন্দী ভনয়।
চর্যা-৪৭
ধর্ম
কমল-কুলিশ মাঝে হলাম মিলিত,
চণ্ডালী সমতা-যোগে হ’ল প্রজ্বলিত।
ডোমনির কুঁড়েঘরে আগুন লেগেছে,
আগুন নেবাই চাঁদ দিয়ে পানি সেচে।
জ্বালা খুব তেজি, তবু
কোনো ধোঁয়া নেই,
মেরুশীর্ষ নিয়ে পশে সোজা গগনেই।
পোড়ে ব্রহ্মা, হরিহর, পুড়ে হয় মুক্ত
তামার শাসনপট্ট, নবগুণযুক্ত।
ধামপাদ বলে, আজ সব স্পষ্ট জানি,
পঞ্চনালে উঠে গেল নির্বাণের
পানি।
চর্যা-৪৯
ভুসুকু
বজ্রনৌকা বেয়ে পাড়ি দেই
পদ্মা খাল,
দেশ লুট ক’রে নিল অদয় বঙ্গাল।
ভুসুকু, বাঙালি হলি আজ থেকে ওরে,
নিজের ঘরনি গেল চাঁড়ালের ঘরে।
জানি না কোথায় ঢুকে মন হ’ল ভ্রষ্ট,
জ্বলন্ত পঞ্চপাটন, ইন্দ্রিয় বিনষ্ট।
সোনা-রুপা কিছু আর রইল না বাকি,
নিজ পরিবারে তবু মহাসুখে থাকি–
নিঃশেষ
হয়েছে যদি চৌকোটি ভাঁড়ার
জীবন-মরণে নাই প্রভেদ আমার।
চর্যা-৫০
শবর
গগনে তৃতীয় বাড়ি, হৃদয়ে কুঠার,
কণ্ঠলগ্না রমণীয়া নৈরামনি নারী–
শবর শূন্যতা-সঙ্গে সুখে আছে ভারি
ঝেড়ে ফেলে মায়া-মোহ-দ্বন্দ্ব-দুঃখ-
ভার।
মহাশূন্যোপম অই বাড়িটির পাশে
ফুটেছে সুন্দর কত কার্পাসের ফুল,
এলিয়ে দিয়েছে চাঁদ জোছনার চুল,
আকাশকুসুম যেন ফুটেছে আকাশে।
খেতে খেতে পেকে ওঠে চিনা ও
কাউন
শবরী শবর মাতে, ভুলে যায় সব;
চার-বাঁশের চেঁচাড়িতে শবরের শব
দাহ করা হয়–কাঁদে শিয়াল-শকুন।
দশ দিশে পিণ্ড পায় মৃত ভবমত্ত,
শবর নির্বাণ লভে, যায় শবরত্ব।