বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ছড়ার যাদুকর জগলুল হায়দার ও আধুনিক প্রেক্ষাপট—রায়ান নূর

ছড়ার নাম মুখে আনলেই সাম্প্রতিক কালে প্রথম যে নামটি মুখে আসে তা জগলুল হায়দার ৷আধুনিক কালে জগলুল হায়দার ছড়ার যাদুকর এবং বিজ্ঞান ছড়ার জনক হিসেবে পরিচিত৷ তাকে আধুনিক অনুকাব্যের পথিকৃত বলা হয়ে থাকে। তরুনদের মাঝে তো বটেই এমনকি দুই বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছেও জনপ্রিয় তিনি ৷ সাম্প্রতিক কালে তিনি নিজে একটা বলয় তৈরি করেছেন প্রজ্ঞা দ্বারা ৷তার ছড়ায় রয়েছে যেমন ছন্দের খেলা তেমনি ভাষাও সম্পূর্ন নতুন আঙ্গিকের ৷ ছড়াকার নিজ প্রয়োজনেই সম্পূর্ন নতুন ও উত্তরাধুনিক শব্দ দ্বারা তৈরি করেছেন নানান অন্ত্যমিল এককথায় ছড়াভাষা ৷ তিনি নব্বই দশকের একবারে শেষের দিক থেকে বিরতিহীনভাবে লিখে গেছেন ছড়া এবং এখনও লিখছেন ৷ প্রতিদিন চা এর কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টোলেই চোখে পড়ে তার ছড়া ৷ তিনি যেন উত্তরাধুনিক ছড়ার প্রবাদ পুরুষ ৷ ছড়াকার সুকুমার রায়,সুকুমার বড়ুয়া এদের বলয়ের বাইরে নিজ ছড়াভাষা প্রয়োগ করে ছড়ায় নতুনত্ব এনেছেন ৷

তিনি সকল ধরনের ছড়া লিখেছেন;রাজনৈতিক,ঐতি­হাসিক,ভালোবাসার ছড়া,লোকজ এমনকি বিজ্ঞান ছড়া লিখেছেন অঢেল ৷ তার ছড়া তত্ত্বে ভরপুর হলেও চমকদার পরিবেশনার কারণে পাঠকের কাছে তা ভারি ঠেকে না। ৷ ছড়ায় যে বিনোদনের মাধ্যমেই তত্ত্ব করা যায় আর তা যে পাঠকের মনের খোরাক মেটাতে পারে এটি একমাত্র তিনিই সফলভাবে প্রমাণ করেছেন ৷ এই পারদর্শিতায় তার ছড়ায় তত্ত্ব ছাপিয়ে বরং হাসিটা মুখ্য হয়ে ওঠে যেমন সুকুমার রায়ের ছড়াতেও দেখা যায় ৷

(1)

আজকে মারেন একে আবার

কালকে মারেন তাকে

এই যদি দেন কানে থাপড়

এই ঘুসি দেন নাকে।

(ছড়াঃ হচ্ছে কি সব )


হাসির ভেতর লুকিয়ে থাকে বিপুল রহস্য আর কলমের মারপ্যাচে রাজনীতিকে যে ছড়ার স্বল্প আয়তনের মধ্যে যে স্থান দেওয়া যায় এর উদাহরণ তার ছড়া ৷ রাজনীতির সুক্ষ অংশগুলো জনসাধারণের কাছে খুব সহজেই কর্ণগোচর করতে পেরেছেন ৷ বৈশ্বিক রাজনীতি,কুটনৈতিক চালচিত্র ও নানা বৈষয়িক প্রসঙ্গ নিয়ে ছড়া রচনা করেছেন তিনি৷ তার ছড়ায় মানবতাবোধ,ক্ষোভ,ভালো­বাসা,জনমানুষের আকাঙ্খা,প্রতিবাদ,ঘৃণা সব কিছু ফুটে ওঠেছে এবং বিবিধ দর্শনে হয়েছে বৈচিত্র্যময় ৷তার কলম একদিকে ভালোবাসাকে যেমন ধারণ করে অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদদের প্রতি প্রতিবাদের তীব্র ভাষাও উচ্চারণ করে ৷ তার এই প্রতিবাদের ধরণই তাকে মনেপ্রাণে উত্তরাধুনিক করে তুলেছে ৷

(2)

ছিটমহলের স্বপ্নগুলো মধ্যিখানে ফেঁসে

আশার তরী তীর পেলোনা আবার গেলো ভেসে; 

ভাল্লাগে না মমতা দি তোমার সাথে আড়ি

জল হারা সব ঢেউয়ের স্মৃতি পদ্মাতে খায় বাড়ি! 

মনমোহনের মনের খবর সোনিয়াজী জানে

পানি ছাড়া প্রাণ আসে না ভাটিয়ালী গানে;

পদ্মা তবু ধুঁকে মরে শুকনো বালু চরে

তিস্তা তিতাস লাইন দিলো সেই মরণের তরে। (ছড়াঃনিষ্ফলা)

(3)

ফেলানি সে মরলো আবার প্রথম মরণ বাদে

ভূভারতে বিবেক কোথায় ভাইবা এ মন কাঁদে।

পাক-চিনে তো হয় না এমন বছর বছর ধরে

কিন্তু দ্যাখো এই বর্ডারে রোজ বাঙালি মরে।

নরম পেয়ে গরম দ্যাখাও বর্ডার বিধির নামে

চীন দিলে তো দাবাড় আবার চান্দি তোমার ঘামে! 

বন্ধু তুমি কেমন বন্ধু বোঝার কি আর বাকি

নেয়ার বেলায় ষোলো আনা দেয়ার বেলায় ফাঁকি! 

মেক্সিকো তো বেশ আছে ভাই আমেরিকার পাশে 

রাশিয়া কি তাজাক-কাজাক কাওরে মারে ফাঁসে? (ছড়াঃ লানৎ)

(4)

বাংলাদেশের বুকের ওপর অ্যাংলো ভূতের মেলা

ঐতিহ্যের এই ভূমিতেই ভানুমতির খেলা?

মানবো এসব মুখ বুজে আর চুষবো আঙুল বসে 

ধন্য ধন্য বলবো সবাই হাতের তালু ঘসে?

(ছড়াঃ বাংলা ছাড়ো)


জগলুল হায়দারের ছড়া নিয়ে এ কথা বললে বেশি হবে না যে বর্তমানে এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় তার ছড়ার ছড়াছড়ি ৷ অসংখ্য ছড়ার বীজ বপন করে গেছেন তিনি ৷এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমালোচক কবি সাযযাদ কাদির বলছেন,"জগলুল হায়দার এত লেখেন। এত ভালোই বা লেখেন কী করে!"পেশা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার হলেও তিনি ছড়াকার ৷তার ছড়া বহুমাত্রিক এবং এ যুগের অন্যান্য ছড়াকারদের তুলনায় তিনি বেশি পারদর্শী ৷তার ছড়ার বহুমাত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায় নতুন স্লোগান,ছাগলশুমারী, দলীয়করণ, উল্টা নিয়ম, স্যাটেলাইট অপকালচার এর মত প্রায় কালজয়ী ছড়ায় ৷ ইতিহাস আজ লিখতে হয়না,ইতিহাস নিজেই লিখে রাখে যুগের ধারককে ৷ এবার অন্যান্য প্রসঙ্গে আসা যাক ৷তার ছড়া একটি বিশেষ সময়কে ধারণ করে তাতে থাকে ইতিহাস ও দেশের বিদ্যমান সংকট ৷তিনি সকল কিছুই ভাবেন নিভৃতে তাই প্রতীয়মান হয় ছড়ায় ৷তিনি যে শুধু ছড়াকার নন তিনি একজন নাগরিক এবং সেই নাগরিক ভাবনা রুচিও প্রাধান্য পেয়েছে তার ছড়ায় ৷ তার সমসাময়িকরা যখন অপেক্ষাকৃত সহজ ও বহুল কথিত গ্রামজীবন নিয়ে কাজ করেন তখন তিনি বেছে নেন তুলনামূলক জটিল ও অল্পকথিত নগরজীবন।

(5)

আমি তুমি তুমি আমি আখেরে এ দেশি তো

মিলেঝিলে পার করো ভোটে কাঁপা এ শীতও! (ছড়াঃসময়ের ধ্বনি)

(6)

গদির প্রেমে গদির প্রেমে

নানান কিন্তু যদির ফ্রেমে

ফাঁসলো আমার দেশ

ভিনদেশি সুর হাওয়ায় ভাসে

বিদেশ থেকে দাওয়াই আসে

টেনশনে চুল শেষ!

(ছড়াঃ পাওয়ার)

(7)

রাজনীতির আণ্ডা ফুঁড়ে

বাচ্চা তো আর ফুটছে না

নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে যায়

তাও অনেকেই উঠছে না।

( ছড়াঃগদির গান)


কোন সফল লেখকই গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না,তিনি ভ্রমন করেন বিশ্বপরিমন্ডলে মনোজগতে অথবা বস্তুজগতে ৷ জগলুল হায়দার এর ব্যতিক্রম তো ননই বরং অন্যদের থেকে এগিয়ে৷ বিষয়টি বাংলার ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে-' বাংলাদেশে বাস করেও বাংলাদেশের হয়েও জগলুল সারা পৃথিবীকে আপন করে দেখেন, নিজের বলে ভাবেন। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সংকট সমস্যায় সরব হন যেন তিনি যথার্থ বিশ্বনাগরিক।'

তিনি বিশ্বসাহিত্যের সংস্পর্শে এসে নিজের ছড়াকে করেছেন সমৃদ্ধ ৷তিনি যে শুধু নিজেই ছড়া লিখেছেন তা নয় ৷ তিনি অনুবাদ করেছেন অনেক নিজের ভাষায় যেমন উইলিয়াম ব্ল্যাক এর লেখা ৷

Eternity

William blake


He who binds himself a joy

Does the winged life destroy;

He who kisses the joy as it flies

Lives in eternity's sunrise.


জগলুল হায়দার অনূদিত


যে বাঁধে আনন্দ স্বর্গে আপনাকে

অনায়াসে পারে নিতে দহনের তাপ নাকে;

ডানা কেটে পতপত ওড়া যার সম্ভব খুব

অনন্ত সূর্যে সেই আঁকে চুমো অপরূপ ৷


ছড়ার যেমন সীমা নেই লেখার তেমনি শেষ নেই ৷ ছড়াসাহিত্য বাংলাভাষার ভিত্তিস্বরুপ যা বহুকাল ধরে জনমানুষের মুখে চালিত ৷ কতিপয় সাহিত্যানুরাগীদের প্রতিভায় থাকে এর বিপূল অগ্রযাত্রা ৷ সাহিত্যরস বিচারে কখনো ছড়ার মূল্যায়ন হয় না বলে অতীতে পণ্ডিতরা বলে গেছেন। বরং বলেছেন ছড়ায় হাস্যরসের প্রাধাণ্য বেশি৷ তারপরও সেই সাহিত্যগুন বিচারেও তার ছড়া যেন উৎড়ে যায় সুখকর অনুভবে৷ আর বিষয় চিন্তা দর্শনের মাপকাঠিতে উত্তরাধুনিক এই বিশ্বায়নের যুগে জগলুল হায়দার সূর্য স্বরুপ ৷ আমাদের ছড়ার নতুন বাতিঘর ৷