শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কবি মনসুর আজিজঃজীবনের খেরোখাতা(অতলান্ত নীল চোখ)—রায়ান নূর

কবি মনসুর আজিজ সাম্প্রতিক কালে খুব সুন্দর কবিতা লেখেন ৷ তার কবিতার প্রধান অলঙ্কার উপমা ও চিত্রকল্প ৷ তার একটি কবিতা আমার নজর কেড়েছে হঠাৎ 'জীবনের খেরোখাতা'৷ এই কবিতাটি "অতলান্ত নীল চোখ(2002)" শীর্ষক কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতা ৷কবিতাটি আমার কাছে মনে হয়েছে হঠাৎ বিশেষ থেকে সামান্যে প্রত্যাবর্তন ৷ কবিতাটিতে কত গুলো উপমা প্রয়োগ হয়েছে যেগুলো সাহিত্যে নতুন ৷ পাঠকের কাছে হয়ত কবিতাটির ভাবার্থ অন্যভাবে ধরা দিবে কিন্তু তার সমালোচনা করলে তাকে তুচ্ছ বলা হবে না ৷"নীল অতলান্ত চোখ" এর একটি চোখ অন্তত এখানে দাড়াতে বাধ্য ৷ কয়েকটি উপমা,প্রতীক লক্ষ্য করা যাক—

হিংস্র নখর—নখরের(নখ) ন্যায় হিংস্র ৷
হৃদয় নহর—নহরের মত বহমান হৃদয় ৷
হিংসা বহর—হিংসা বহনকারী বাহনসমষ্টি ৷
শান্ত দুপুর—দুপুরের ন্যায় শান্ত যে ছবি ৷
ঘাসকুঁড়ি—কুঁড়ির ন্যায় প্রস্ফুটিত ঘাস ৷
খেরোখাতা—খেরুয়া কাপড়(লাল বর্ণের সুতা) দ্বারা মোড়া খাতা (দীনবন্ধু মিত্র কর্তৃক ব্যবহৃত শব্দ)

এই উপমাগুলো একবারে নতুন ৷ শব্দ ব্যবহারে কবির দক্ষতা রয়েছে ৷ কিন্তু তা কতটা প্রাসঙ্গিক তা আলোচ্য বিষয় হতে পারে ৷ কবির জীবনের ইতিবৃত্ত খানিকটা ফুটে ওঠেছে এই কবিতায় ৷ বিদেশী কতগুলো শব্দ কবি আত্নগত করেছেন নিপূনভাবে যেমন— নহর;মনজিল;জানোয়ার;ফার্নেস ৷

আলোচনায় আসা যাক প্রথম চার পঙ্কতিঃ


এলোমেলো হল আজ জীবনের খেরোখাতা
ঢেউ ভাঙে তীর ভাঙে জীবনের স্মৃতি ভেঙে বহু ভাজ
নরম ঘাসের পরে হেটে যায় হিংস্র জানোয়ার
ঘাসকুঁড়ি কেঁপে ওঠে কেঁদে ওঠে কাঁপিয়ে ভুবন ৷

কবির অবসাদ গ্রস্তের একটি দারুন চিত্রকল্প ৷ জীবনের খেরোখাতা এলোমেলো হয়ে কবির স্মৃতির তীর ভেঙে করেছে খন্ডিত ৷আর এর পেছনে কবি কারণ নির্দেশ করেছেন তার সমতল,বহমান স্থিতিস্থাপক জীবনে হিংস্র জানোয়ারের ন্যায় কতিপয় মানুষ হেঁটে চলে তার স্বপ্নগুলোকে বাধাগ্রস্ত করেছে ৷ এই লাইনগুলোতে যতিচিহ্নের প্রতি কবির অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে ৷ এখানে যতিচিহ্ন প্রয়োগ হত দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে যা কবির ইচ্ছাকৃত অথবা অনাকাঙ্খিত ভুল সিদ্ধান্ত ৷ আবার কবির একটি বাক্য
"ঢেউ ভাঙে তীর ভাঙে জীবনের স্মৃতি ভেঙে বহু ভাজ"৷ 
ঢেউ ভাঙে শব্দটা প্রায়োগিক দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ কেননা ঢেউ ভাঙতে পারে না কিন্তু তীর ভাঙতে পারে ৷ ঢেউ যদিও ভাঙে তা জলাশয় হবে এবং স্থবির হবে আর তাকে ঢেউ বলা যাবে না যা তীর ভাঙতে অক্ষম ৷ আবার স্মৃতি মুছে যেতে পারে,বিবর্ণ হতে পারে কিন্তু ভাঙতে পারে না ৷ আর যদিও ভাঙে তার ভাঁজ হয় না ৷ শব্দ প্রয়োগের দিক থেকে লাইনটি অর্থহীন ৷স্মৃতি ভিসিডি ডিস্কের মত ভাঙলে পুরো কবিতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে ৷

দ্বিতীয় স্তবকে


ঢেউ ভাঙে জল ভাঙে ভেঙে চলে জীবনের শান্তপুকুর
পাতা নড়ে পাতা ঝরে নড়ে ওঠে শান্তদুপুর
দেহ জুড়ে বয়ে যায় ঝড়ের কাঁপন
খেরোখাতা ছিড়ে যে ছিল আপন ৷

এই স্তবকের সারাংশ এই, স্থবির জীবনের আশাগুলো খন্ড খন্ড ভাঙনে যাত্রা শুরু করার পর মধ্যাহ্নে তার স্বপ্নগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে আর সেগুলো তার কোন আপনজনের চক্রান্তে ৷ 
কবি আবারও প্রথম বাক্যে একই ভুল করেছেন নিছক চিত্রকল্পের খাতিরে যা অবান্তর ৷ জল ভাঙে এবং ভাঙতে পারে আর শান্ত পুকুর গতিময়তা পেতে পারে কিন্তু ঢেউ ভাঙতে পারে না বরং হারাতে পারে ৷ এখানেও প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনে যতিবিভ্রম ঘটেছে যা পাঠকের কাছে কাম্য নয় ৷

তৃতীয় স্তবকে


হিংস্র নখর কতো ছিঁড়ে ফেলে হৃদয় নহর
দুপুরের ঝলকানি ঢেলে দেয় হিংসা বহর
দয়িতার স্বপনের চূড়া ভেঙে মনজিল শেষ
পিদিমেরা কেঁদে ওঠে হায় ফার্নেস ৷

এই স্তবকের সারাংশ এই,  জীবন মধ্যাহ্নে হিংসুক হিংস্র পশুর নখের আঘাতে তার হৃদয়ের স্বপ্নের মঞ্জিল ছিন্ন ভিন্ন আর তাই ছোট আশা গুলো পুনরুজ্জীবনের কাছে বিলাপ করে ৷ এই সারাংশ যে স্তবকে ফুটে ওঠেছে তা যে কবির কৃতিত্ব তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন কিনা তা আলোচ্য বিষয় ৷
হৃদয় নহর ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয় কেননা এটা খেরোখাতা নয় ৷ হৃদয় নহর বিদ্ধ হয়,জ্বলতে পারে,আন্দোলিত হতে পারে,ফেটে যেতে পারে,ভাগ হতে পারে কিন্তু ছিড়তে পারে না ৷ আবার কবি নিজের একান্তে কবিতা শুরু করলেও এখানে এসে প্রয়োগ করেছেন বহুজনের কাছে ৷ তার প্রথম প্রমাণ প্রথম লাইনে 'কতো'  শব্দে পাঠকের কাছে তা উন্মোচিত হয়েছে ৷ আবার দুপুরের ঝলকানি বলতে পুনরুজ্জীবনকে নির্দেশ করেছেন কিন্তু এমনভাবে প্রয়োগ করছেন যেন কবি নিজেই অন্যকে হিংসা করছেন ৷ তার প্রমাণ তৃতীয় লাইনে দয়িতা(নারী) শব্দে উন্মোচিত হয়েছে ৷ এখানে একজন নারী হিসেবেও কবি আত্নপ্রকাশ করেছেন আবার শত্রু হিসেবেও আত্নপ্রকাশ করেছেন যা বিরোধাভাস ৷ কবি এখানে ইঙ্গিত সূচক কোন বাক্য ব্যবহার করেন নি অস্পষ্টতা দুর করার জন্য ৷ দুপুরের ঝলকানিকে যদি ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করি তবে প্রথম লাইনটি অর্থহীন মনে হয় ৷ চতুর্থ লাইনে পিদিমেরা শব্দটি বহুবচন করে সংহত একটা ভাবকে আবারও বিতর্কিত করেছেন ৷চিত্রকল্পের খাতিরে পাঠকের কাছে সুক্ষ বিষয় অনুভূত হওয়ার কথা ন়য় বরং আবেগটা প্রাধান্য দিয়েছেন কবি ৷ এটা কবির নারীরূপ কল্পনা যা দয়িতা শব্দে দৃষ্টিগোচর হয়েছে ৷

চতুর্থ স্তবকেঃ


হুকা থেকে উড়ে আসে নিঃশেষ ধোঁয়া
হায় কেন সাধ হল খেরোখাতা ছোঁয়া

দুই লাইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হল হুকার ধোঁয়া নিঃশেয় হয়েছে অর্থাৎ জীবনের সায়াহ্নে আগমন আর কবির ভুল যে অন্যের খেরোখাতা ছুয়েঁ ফেলা ৷

'জীবনের খেরোখাতা' যে শুধু কবির একার খাতা নয় তার সাথে জড়িয়ে আছে মলাটবন্দী আরেক খাতা ৷ পরস্পর বিরোধের কারণে দুইজনই যে নিভু নিভু অর্থাৎ সংসারে আবদ্ধ তা পরস্পর বিরোধী ভাষ্যে উন্মোচিত হয়েছে ৷ একজন ছিঁড়ে ফেলে যন্ত্রনা দিয়েছে আর একজন ছুঁয়ে যন্ত্রনা পেয়েছে ৷ কবি হয়ত কল্পনা করতে পারেন নি  যে তিনি নিজেই শত্রুবেশে সংসারধর্মে নায়ক ৷ কবিতার ভাবগত দিকটা সম্পূর্ণ নতুন এর আগে এ রকম কবিতা লিখিত হয় নি ৷ মানুবজীবনের অগ্রযাত্রায় সংসার যে উপযাচক তাই কবির ভাষ্য ছিল এই কবিতায় ৷