বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

আধুনিক কবি ও কবিতা—রায়ান নূর

কবি একজন কবি হয়ে ওঠে কখন? অনেকে হয়ত বলবে কবিতা যারা লিখে তারাই কবি ৷ এমন প্রশ্নের সদুত্তর সহজে মিলবেনা ৷ আবার যিনি কবিতা লিখেন না তাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনেক কবির মনে বাধবে ৷ তাই এর একটি সুরাহা হওয়া প্রয়োজন ৷

আমি যদি বলি বঙ্কিম চন্দ্র একজন কবি ৷ এ যুগের কোন সাহিত্যিক উপযুক্ত কারণ ছাড়া স্বীকার করবেন না ৷ যদি কয়েকগাদি কারণ হাজির করি অনেক কবি প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে আমাকে গালি দিবেন ৷ কারণটা মুখ্য এই যে সাহিত্যসমাজে প্রচলিত আছে কবিতা তখনই কবিতা হবে যখন দেখতে কবিতার মত হবে ৷ এই যুক্তি যদি তর্কে টিকে তাহলে একজনকে যিনি কবিতা লিখেন না তাকে কবি বলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ৷

শুরুতে পুথি সাহিত্যে আসা যাক, কাছাছুল আম্বিয়া,গওহর বাদশাহ ও বানেছা পরী,শেখ ফরিদের পুথি এসব পদ্য ছন্দে রচিত;তখনো মানুষের মুখের ভাষা সাহিত্যিক রূপ পায় নি ৷তাহলে এসব লেখককে আমরা কোন শ্রেণিতে রাখব?জেনে রাখা ভালো—সাহিত্যের সুচনা লগ্নে প্রথম হল গান, যা মানুষের মনের অভিব্যক্তি বাধাহীন ভাবে উৎসারিত হয় অবশ্য পদ্যই গান হিসেবে গাওয়া হত,এর পরে আসে কবিতা অর্থাৎ যেখানে মনের ভাব কিছুটা গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয় ৷ তারপর নানা কারুকার্য যেমন বহুল আলোচিত পয়ার, অলংকার দিয়ে সাজানো হয় ৷ বাংলা ভাষায় গদ্য সাহিত্যের আগমন বেশি দিনের নয় ৷ তাই গান আর পদ্য ছিল ভাব প্রকাশের মোক্ষম ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সহজ পথ হিসেবে গদ্য চালু করে ৷প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের মুখের ভাষাকে এই প্রথম বিট্রিশরা সাহিত্যিক ভাবে চালু করে ৷ আর আমাদের পন্ডিতদের পরিশ্রমে আজ বাংলাভাষার এই রূপ৷

গানকে কবিতার মর্যাদা দেওয়া যায় কেননা গানই কবিতার উৎস; অবশ্যই সুর থাকত বলেই পদ্যগুলো সেতার বা মুখে গাওয়া যেতো ৷ মনে রাখা প্রয়োজন সব পদ্যই কবিতা অথচ সকল কবিতা পদ্য নয় ৷ পদ্য হল সাহিত্যের ভাষারীতি আর কবিতা হল শিল্প ৷ বাংলাসাহিত্যের পুরনো গ্রন্থের পদ গুলো অনেকাংশে পদ্যগান যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল ৷ চর্যাপদ তেমনি এক নিদর্শন ৷ তার পড়ে ইংরেজরা গদ্য ব্যবহার করে ৷ রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,প্রমথ চৌধুরী আরো অনেকের প্রচেষ্ঠায় গদ্য জনসাধারনের কাছে শিথিল হয় ৷ কিন্তু আধুনিক কালে কবিতাকে বন্দী করে রাখা হচ্ছে একটি গন্ডীর মধ্যে ৷ কবিতা কেমন করে কবিতা হবে তা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা হয়েছে তার উদাহরণ এই যে শুদ্ররা বেদ পড়তে ও ছুতে পারবে না, তেমনি কেউ একটা কবিতা লিখে দেখালে হয়ত অনেক খ্যাতনামা কবি না পড়েই বলবেন এটা কবিতা হয়নি ৷ আর একারণে বঙ্কিমকে কবি বলতে সঙ্গত কারনে বাধবে ৷ তার লেখা কপালকুন্ডলা যখন পাঠ করা হয় তখন ভাষার ঝলকানি পাওয়া যায় আর কাব্যময় হয়ে ভাব ফুটে ওঠে ৷ আধুনিক পরিভাষায় সেটা কাব্য হিসেবে বিচার করতে কোন বাধা নেই ৷ এই বঙ্কিমকে বিশ্বকবি অনুসরণ করে নিজ পথ তৈরি করে নিয়েছেন তাই তিনি ছোট হয়ে জান নি ৷ মানুষের মনের ভাষা আর উপলব্ধ হৃদয়াবেগ কবিতাসাহিত্যের মূলধারা ৷আধুনিক কবিতা অনেকাংশে বর্ণণাত্নক হয়ে গেছে আর পয়ার ওঠে গেছে তবুও উপমার ব্যবহার এতটুকু কমেনি ৷ এসব কবিতার কথা বিবেচনা করলে আগের যুগে অনেক সাহিত্যিককে আমাদের কবির মর্যাদা দিতে বাধা নেই ৷ বর্তমান কালে প্রবন্ধ ও কবিতার কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় ৷ পার্থক্য এই ভাবের মধ্যে ৷ আধুনিক কবিরা অনেক দলে বিভক্ত হয়ে গেছে সুতরাং যুগের সাথে কাওকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে সবার অনীহা ৷ কোন কবি দেহতত্ত্ব,কেউ দর্শন,কেউ প্রকৃতি,কেউ প্রেম-বিরহ,কেউ স্তুতিমূলক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে লিখছেন ৷ তাই কেউ কারো কবিতার সাথে নিজ মনন না মিললে তা একরোখা ভাবে দেখেন ৷ এটা কখনও প্রকৃত কবির লক্ষণ হতে পারে না ৷ কবিতার সাথে কবির জীবনদৃষ্টি অমিল হলে লেখা হয় সাহিত্য হয় না কেননা সাহিত্য বিচারে অনেক মানদন্ড বিচার করতে হয় ৷ কবিকে তখনই সার্থক বলব আমি যখন কবি নিজস্ব সৃষ্টিতে সকলের বোধসম্পন্ন দর্শন,তত্ত্ব,বিজ্ঞান,প্রকৃতিকে একিভূত করতে পারবেন ৷ বর্তমানে আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচার হয় কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি ৷ কেন?তার কারণ একটাই মনে করি যে কেউ একটা কিছু লিখে শ্রেষ্ঠত্ব আর প্রচারমুখী হচ্ছে ৷ এটার অর্থ কী?যারা এর চেয়ে দৈন্যদশায় অথচ অনেক অভিজ্ঞ তারা পিছে পড়ে যাচ্ছেন ৷ একবিংশ শতাব্দীতে এইসব সাহিত্য বিচারে কাকে মূল্যায়ণ করব?কবিতা আর কবি অসংখ্য ৷ আধুনিক কবিতার গদ্য কবিতা দেখলে মনে হয় আমরা যেন বঙ্কিমের যুগে পড়ে গেছি সুতরাং তাহলে আধুনিক গদ্য কবিতার জনক কাকে বলব ? কবিতা যদি কারো বোধসম্পন্ন না হয় তা ধাতস্থ হয় না ৷ সময়ের সাথে কবিতাও সহজবোধ্য হবে কিন্তু এ যুগে উল্টো ৷ আবেগ কেমন কৃত্রিম আর শহুরে যান্ত্রিকতায় ভরপুর ৷ মধুসূদনের কবিতা যেমন অন্তরে বিধতো না কিন্তু বাজত সেই রকম হয়ে গেছে ৷ নিশ্চয়ই কোন বিষয় ছাড়া শুধু অলংকার দিয়ে সাহিত্যবিচার হয় না ৷ বিষয় নির্ধারন হয় দুইভাবে মনুষ্যত্বওদর্শন আর কাল বাস্তবতা ৷

প্রত্যেক কবিদের আলাদা মনোজগৎ আছে এবং সেই জগতে সে নক্ষত্র ৷কবিকে ভালোভাবে জানতে হলে কবিতা পড়তে হবে ৷ তাকে তিরস্কার করা কোন কবির কবিত্বের লক্ষন নয় ৷ তার কবিতা বিচারে এটাই মুখ্য ৷ অনেক কবিরা অন্য কবিদের প্রভাবিত করেন ৷ যারা সুনামধারী তাদেরকে অনুসরণ করার কারণে নিজপথে বাধার সমুক্ষিন হচ্ছে ৷ যারা ছন্দ ব্যবহারের বিরোধী আর
যারা ছন্দে লেখে তারা দুই মেরুতে ৷ আধুনিক কবিরা ছন্দে অনিহা প্রকাশ করে আবার তারা প্রচার যন্ত্রে সুবিধাভুগী ৷ তাই কবি বাড়ছে ঠিকই কিন্তু জ্ঞান আর ভাবের অভাব ৷ প্রচার যন্ত্র নাগালে এলে রাতারাতি জাদরেল কবি বা সাহিত্যিক হয়ে উঠছে
৷ভালো কোন জিনিস কেউ  যদি এখনই মূল্যায়ন না করি এই শতকে অনেক প্রতিভা ঝড়ে যাবে কিন্তু স্বনামধন্য আর জনবিচ্ছিন্ন পাতাসর্বস্ব বটগাছের আবির্ভাব হবে ৷