বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

মনুষ্যত্বঃহৃদয়,মন ও বিবেক— রায়ান নূর

শুরুতে একটা উড়ো ভাবনা মনে আসলো যে মন, হৃদয় ও বিবেক ৷ তাহলে প্রশ্নটা এই তা হল এই তিনটি ইন্দ্রিয়গ্রাহী জিনিস কি এক ? মানুষের প্রধান ধর্ম মনুষ্যত্ব ৷ যার মনুষ্যত্ব নেই তাকে মানুষের কোনো শ্রেণিতে রাখা আদৌ কি সম্ভব? মনুষ্যত্বই হল মানব ধর্ম ৷ মানবধর্মকে সবার আগে স্থান দিতে হয় ৷ আর এই মানবধর্মকে গন্তব্যে নিয়ে যায় ঐশীধর্ম ৷ মানব ধর্ম যার মনে বাসা বাধেনা তাকে কোন ঐশীধর্ম পথ দেখাতে পারে না ৷ পার্থিব ধর্ম বলে কিছু নেই ৷ঐশী ধর্মের অনুপস্থিতিতে মনুষ্যত্বজাত ধর্মই প্রভাব বিস্তার করে ৷ একটা সুত্র যাচাই করে দেখা যাক মনুষ্যত্বের দ্বন্দ্ব ৷ যদি কেউ রাজার আসনে বসে তাহলে প্রথম সে কি করে ৷ সে যদি জ্ঞানী হয় আর ন্যায় হয় তবে তার কাজ হয় সম উত্তরাধিকারীকে হত্যা করা ৷যদিও হোক আপনজন আর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে তা জানা যায় ৷ রাজ্যের প্রজার কল্যাণে তাকে এই অপ্রিয় কাজটি করতে হয় ৷ নিজ পিতা,কিংবা মাতা কিংবা ভাই কিংবা বোন ৷ সকলেই তাকে পাষন্ড আর কলঙ্কিত বলে অভিহিত করে ৷ মনুষ্যত্বের দ্বন্দ্ব চরমে যায় যখন বিবেক ক্রিয়াশীল হয় ৷ কারো আবেগে এই ঘটনা তাকে নিন্দিত করবে আবার কেউ নন্দিত করবে ৷ তার কারণ এই সকলের মনুষ্যত্ববোধ একই পথে গমন করে না ৷ এ কারণে ঐশী ও স্থায়ী ধর্মের আগমন এই দ্বন্দ্বকে প্রশমন করার জন্য ৷ কেউ আবেগ দ্বারা চালিত,কেউ মন দ্বারা, কেউ বিবেকদ্বারা ৷ আবেগ বেশী হলে বিবেক ন্যায়বিচার করতে পারেনা ৷ মন চিরকালই অস্থিতিশীল ও দুরন্ত ৷ যে কোন সময় তার ভাবনা পাল্টে ৷ আবেগ বেশি অনুভূত হলে হৃদয়ে আসন গাড়ে ৷ আর বিবেক তখনো স্থির থাকে ৷ বিবেক কেবল তখনই জেগে উঠবে কোন ঘটনার দ্বন্দ্বে যখন তাকে কোন প্রশ্ন করা হবে ৷ প্রশ্ন ছাড়া বিবেক ঘুমন্ত ৷ কেবল প্রশ্ন করলেই সঠিক বিচার করবে আর তার ভালো দিক নির্দেশ করবে এবং মনের নিয়ন্ত্রন নেবে,হৃদয়ের নয় ৷ তুমি কাওকে হত্যা করে বিবেককে প্রশ্ন করবে 1৷তুমি কেন তাকে হত্যা করলে? 2৷ তার দোষ কতটুকু ছিল? 3৷ তুমি তাকে হত্যা করে ঠিক করলে? বিবেক তখন যাচাই করবে ৷ তাই সকলে এক বোধ সম্পন্ন নয় ৷ তোমার চোখে যা ঠিক অন্যের চোখে তা ঠিক নাও হতে পারে ৷ রাজা ও প্রজার তফাৎ এখানেই ৷ একজন বিচারক নিজ আসনে বসে কখনো হৃদয়বৃত্তি দ্বারা চালিত হবেন না কেননা তার আসনকে কলঙ্কিত করবে সে ৷ কেবল বিবেকই আসনের যোগ্য ৷ রাজার মুকুট ও সিংহাসন তাই নির্ধারিত ৷ এই মুকুট যার শোভা পাবে সেই আনুগত্যপ্রাপ্য ৷ এই নীতি ইতিহাসের শুরু থেকে কেননা মনুষ্যত্ব এই ধর্মে এক ৷ আর এটা পার্থিব বা মনুষ্যজাত ধর্ম নয় এটা ঐশী ধর্ম ৷তাই বলতে হয় মন ,হৃদয় ও বিবেক আলাদা জিনিস ৷ আমার দর্শনে মন হল মধ্যমপন্থী ও অস্থিতিশীল ৷ হ়দয় ডানপন্থী ও স্থিতিথাপক ও আবেগচালিত৷ বিবেক মস্তিস্কজাত ও চরম শুদ্ধ ও ন্যায় বিচারক ৷এই ধারণা সকলের থাকা উচিত ৷ মানুষ শ্রেষ্ঠ জাতি ৷মনুষ্যত্ব বোধ আছে বলেই শ্রেষ্ঠ আর কারো মনুষ্যত্ব না থাকলে তাকে মানুষ আখ্যা দেওয়া যায় না ৷ স্থান,কাল ও পাত্রভেদে মন,হৃদয় ও বিবেকের সহাবস্থান থেকেই মনুষ্যত্বের উদ্ভব ৷ কোন একটার অচলাবস্থা মনুষ্যত্বের দরজা বন্ধ করে ৷ মনুষ্যত্বের দ্বন্দ্বকে ঐশী ধর্ম ছাড়া নিবারণ কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় ৷ তাই একজন সৃষ্টিকর্তা যে আছেন তা অবিশ্বাস করার মতো কোন যুক্তি মনুষ্যত্বে নেই ৷ এই সম্বন্ধে কোন দ্বন্দ্ব মনুষ্যত্বের নয় বরং হৃদয়ের আর মনের বিবেকের নয় ৷ তিনটির পারস্পারিক সিদ্ধান্তহীনতা হলেই তা মনুষ্যত্বের দ্বন্দ্ব ৷ মন,হৃদয় আর বিবেকই একজন মানুষকে মানুষ হিসেেব পরিচিত করে ৷

আধুনিক কবি ও কবিতা—রায়ান নূর

কবি একজন কবি হয়ে ওঠে কখন? অনেকে হয়ত বলবে কবিতা যারা লিখে তারাই কবি ৷ এমন প্রশ্নের সদুত্তর সহজে মিলবেনা ৷ আবার যিনি কবিতা লিখেন না তাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনেক কবির মনে বাধবে ৷ তাই এর একটি সুরাহা হওয়া প্রয়োজন ৷

আমি যদি বলি বঙ্কিম চন্দ্র একজন কবি ৷ এ যুগের কোন সাহিত্যিক উপযুক্ত কারণ ছাড়া স্বীকার করবেন না ৷ যদি কয়েকগাদি কারণ হাজির করি অনেক কবি প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে আমাকে গালি দিবেন ৷ কারণটা মুখ্য এই যে সাহিত্যসমাজে প্রচলিত আছে কবিতা তখনই কবিতা হবে যখন দেখতে কবিতার মত হবে ৷ এই যুক্তি যদি তর্কে টিকে তাহলে একজনকে যিনি কবিতা লিখেন না তাকে কবি বলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ৷

শুরুতে পুথি সাহিত্যে আসা যাক, কাছাছুল আম্বিয়া,গওহর বাদশাহ ও বানেছা পরী,শেখ ফরিদের পুথি এসব পদ্য ছন্দে রচিত;তখনো মানুষের মুখের ভাষা সাহিত্যিক রূপ পায় নি ৷তাহলে এসব লেখককে আমরা কোন শ্রেণিতে রাখব?জেনে রাখা ভালো—সাহিত্যের সুচনা লগ্নে প্রথম হল গান, যা মানুষের মনের অভিব্যক্তি বাধাহীন ভাবে উৎসারিত হয় অবশ্য পদ্যই গান হিসেবে গাওয়া হত,এর পরে আসে কবিতা অর্থাৎ যেখানে মনের ভাব কিছুটা গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয় ৷ তারপর নানা কারুকার্য যেমন বহুল আলোচিত পয়ার, অলংকার দিয়ে সাজানো হয় ৷ বাংলা ভাষায় গদ্য সাহিত্যের আগমন বেশি দিনের নয় ৷ তাই গান আর পদ্য ছিল ভাব প্রকাশের মোক্ষম ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সহজ পথ হিসেবে গদ্য চালু করে ৷প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের মুখের ভাষাকে এই প্রথম বিট্রিশরা সাহিত্যিক ভাবে চালু করে ৷ আর আমাদের পন্ডিতদের পরিশ্রমে আজ বাংলাভাষার এই রূপ৷

গানকে কবিতার মর্যাদা দেওয়া যায় কেননা গানই কবিতার উৎস; অবশ্যই সুর থাকত বলেই পদ্যগুলো সেতার বা মুখে গাওয়া যেতো ৷ মনে রাখা প্রয়োজন সব পদ্যই কবিতা অথচ সকল কবিতা পদ্য নয় ৷ পদ্য হল সাহিত্যের ভাষারীতি আর কবিতা হল শিল্প ৷ বাংলাসাহিত্যের পুরনো গ্রন্থের পদ গুলো অনেকাংশে পদ্যগান যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল ৷ চর্যাপদ তেমনি এক নিদর্শন ৷ তার পড়ে ইংরেজরা গদ্য ব্যবহার করে ৷ রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,প্রমথ চৌধুরী আরো অনেকের প্রচেষ্ঠায় গদ্য জনসাধারনের কাছে শিথিল হয় ৷ কিন্তু আধুনিক কালে কবিতাকে বন্দী করে রাখা হচ্ছে একটি গন্ডীর মধ্যে ৷ কবিতা কেমন করে কবিতা হবে তা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা হয়েছে তার উদাহরণ এই যে শুদ্ররা বেদ পড়তে ও ছুতে পারবে না, তেমনি কেউ একটা কবিতা লিখে দেখালে হয়ত অনেক খ্যাতনামা কবি না পড়েই বলবেন এটা কবিতা হয়নি ৷ আর একারণে বঙ্কিমকে কবি বলতে সঙ্গত কারনে বাধবে ৷ তার লেখা কপালকুন্ডলা যখন পাঠ করা হয় তখন ভাষার ঝলকানি পাওয়া যায় আর কাব্যময় হয়ে ভাব ফুটে ওঠে ৷ আধুনিক পরিভাষায় সেটা কাব্য হিসেবে বিচার করতে কোন বাধা নেই ৷ এই বঙ্কিমকে বিশ্বকবি অনুসরণ করে নিজ পথ তৈরি করে নিয়েছেন তাই তিনি ছোট হয়ে জান নি ৷ মানুষের মনের ভাষা আর উপলব্ধ হৃদয়াবেগ কবিতাসাহিত্যের মূলধারা ৷আধুনিক কবিতা অনেকাংশে বর্ণণাত্নক হয়ে গেছে আর পয়ার ওঠে গেছে তবুও উপমার ব্যবহার এতটুকু কমেনি ৷ এসব কবিতার কথা বিবেচনা করলে আগের যুগে অনেক সাহিত্যিককে আমাদের কবির মর্যাদা দিতে বাধা নেই ৷ বর্তমান কালে প্রবন্ধ ও কবিতার কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় ৷ পার্থক্য এই ভাবের মধ্যে ৷ আধুনিক কবিরা অনেক দলে বিভক্ত হয়ে গেছে সুতরাং যুগের সাথে কাওকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে সবার অনীহা ৷ কোন কবি দেহতত্ত্ব,কেউ দর্শন,কেউ প্রকৃতি,কেউ প্রেম-বিরহ,কেউ স্তুতিমূলক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে লিখছেন ৷ তাই কেউ কারো কবিতার সাথে নিজ মনন না মিললে তা একরোখা ভাবে দেখেন ৷ এটা কখনও প্রকৃত কবির লক্ষণ হতে পারে না ৷ কবিতার সাথে কবির জীবনদৃষ্টি অমিল হলে লেখা হয় সাহিত্য হয় না কেননা সাহিত্য বিচারে অনেক মানদন্ড বিচার করতে হয় ৷ কবিকে তখনই সার্থক বলব আমি যখন কবি নিজস্ব সৃষ্টিতে সকলের বোধসম্পন্ন দর্শন,তত্ত্ব,বিজ্ঞান,প্রকৃতিকে একিভূত করতে পারবেন ৷ বর্তমানে আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচার হয় কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি ৷ কেন?তার কারণ একটাই মনে করি যে কেউ একটা কিছু লিখে শ্রেষ্ঠত্ব আর প্রচারমুখী হচ্ছে ৷ এটার অর্থ কী?যারা এর চেয়ে দৈন্যদশায় অথচ অনেক অভিজ্ঞ তারা পিছে পড়ে যাচ্ছেন ৷ একবিংশ শতাব্দীতে এইসব সাহিত্য বিচারে কাকে মূল্যায়ণ করব?কবিতা আর কবি অসংখ্য ৷ আধুনিক কবিতার গদ্য কবিতা দেখলে মনে হয় আমরা যেন বঙ্কিমের যুগে পড়ে গেছি সুতরাং তাহলে আধুনিক গদ্য কবিতার জনক কাকে বলব ? কবিতা যদি কারো বোধসম্পন্ন না হয় তা ধাতস্থ হয় না ৷ সময়ের সাথে কবিতাও সহজবোধ্য হবে কিন্তু এ যুগে উল্টো ৷ আবেগ কেমন কৃত্রিম আর শহুরে যান্ত্রিকতায় ভরপুর ৷ মধুসূদনের কবিতা যেমন অন্তরে বিধতো না কিন্তু বাজত সেই রকম হয়ে গেছে ৷ নিশ্চয়ই কোন বিষয় ছাড়া শুধু অলংকার দিয়ে সাহিত্যবিচার হয় না ৷ বিষয় নির্ধারন হয় দুইভাবে মনুষ্যত্বওদর্শন আর কাল বাস্তবতা ৷

প্রত্যেক কবিদের আলাদা মনোজগৎ আছে এবং সেই জগতে সে নক্ষত্র ৷কবিকে ভালোভাবে জানতে হলে কবিতা পড়তে হবে ৷ তাকে তিরস্কার করা কোন কবির কবিত্বের লক্ষন নয় ৷ তার কবিতা বিচারে এটাই মুখ্য ৷ অনেক কবিরা অন্য কবিদের প্রভাবিত করেন ৷ যারা সুনামধারী তাদেরকে অনুসরণ করার কারণে নিজপথে বাধার সমুক্ষিন হচ্ছে ৷ যারা ছন্দ ব্যবহারের বিরোধী আর
যারা ছন্দে লেখে তারা দুই মেরুতে ৷ আধুনিক কবিরা ছন্দে অনিহা প্রকাশ করে আবার তারা প্রচার যন্ত্রে সুবিধাভুগী ৷ তাই কবি বাড়ছে ঠিকই কিন্তু জ্ঞান আর ভাবের অভাব ৷ প্রচার যন্ত্র নাগালে এলে রাতারাতি জাদরেল কবি বা সাহিত্যিক হয়ে উঠছে
৷ভালো কোন জিনিস কেউ  যদি এখনই মূল্যায়ন না করি এই শতকে অনেক প্রতিভা ঝড়ে যাবে কিন্তু স্বনামধন্য আর জনবিচ্ছিন্ন পাতাসর্বস্ব বটগাছের আবির্ভাব হবে ৷

ছড়াকার জুলফিকার শাহাদাৎ ও সমকালীন প্রসঙ্গ—রায়ান নূর

বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে জুলফিকার শাহাদাৎ একটি পরিচিত নাম। দীর্ঘ দু দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে নিয়মিত লেখালেখি করে আসছেন। ব্যক্তি জীবনে শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত ড.ইউনুসের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন ৷ ১৯৮৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে পদচারণা এ খ্যাতনামা পুরুষের।এ পর্যন্ত তাঁর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো ৷ ছড়ার পাশাপাশি কিশোর কবিতা লিখে পেয়েছেন খ্যাতি। লিখেছেন ছোটদের জন্য গল্প,কবিতা,ছড়া ও কিশোর উপন্যাস। দুই বাংলার জনগনের মুখে মুখে তাঁর ছড়া পৌছে গেছে ৷ এই কৃতিত্বের দাবী তাঁর ৷ শুধু বাংলা ছড়া নিয়েই বাংলাদেশে এই প্রথম তিনিই লিখেছেন দুটি প্রবন্ধের বই।এ বই দুটি পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

জুলফিকার শাহাদাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার ভুজপুর থানার নারায়ণ হাট ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এদেশের মাটি,মানুষ ও সামাজিক বাস্তবতা ৷ বিশেষত তার ছড়ায় স্থান পেয়েছে রাজনীতি,দেশজ ও আধুনিক সংস্কৃতি,রোমান্টিক ভাবনা,লৌকিক ব্যবহার,বিশেষভাবে সমকালীন প্রেক্ষাপট ৷ এমনকি হলুদ সাংবাদিকতা ও রাজনীতিবিদদের নীতিহীনতা তাঁর ছড়ায় আসন পেয়েছে ৷সকল রকমের ছড়াতে পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছেন এই খ্যাতনামা পুরুষ ৷ তিনি নানা রকমের
ছন্দ,রূপক,উপমা,শ্লেষ,বক্রোক্তি,লৌকিক অনুষঙ্গে ছড়ার জগতে আলোড়ন তুলেছেন ৷ সাহিত্য যখন রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,বুদ্ধদেব বসু,সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর সুকুমার রায় এর বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন এই ক্ষনজন্মা পুরুষ আধুনিক শব্দ চয়নে দেখালেন পান্ডিত্য ৷ সুদূর পার্বত্য এলাকার নৈসর্গিক প্রক়ৃতি আর প্রত্যক্ষ দেশের লোকজ,কালিক,আর ব্যক্তিগত অন্তর্দর্শনে ইতিহাস আর ঐতিহ্য বহন  করে তাঁর ছড়া ৷রাজনৈতিক পটভূমিকে এই শিল্পী এঁকেছেন আজব মেশিনের অবয়বে ৷

দেখুন দেখুন স্যার-
একটা আজব মেশিন এলো
আজগুবি কারবার।
এই মেশিনের গুনের কথা
যাচ্ছে শোনা যথাতথা-
ঢুকলে এতে পাচ্ছে সবাই হাজার উপকার-
আবার দেখি মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে রাজাকার।
রাজাকার আর আলবদরে এই মেশিনে ঢুকে-
বের হচ্ছে অন্যদিকে জয়বাংলা মুখে
                                        (ছড়াঃ আজব মেশিন)
 
বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে অতিক্রম করে তাঁর ছড়া পশ্চিম বঙ্গের জনগনের কাছেও স্থান পেয়েছে ৷কলকাতার বিভিন্ন কাগজে তাঁর ছড়া,
কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।আবৃত্তিতে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে মিডিয়ায় এসেছেন নক্ষত্র রূপে ৷বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ছড়া-কবিতা পাঠে তাঁর অংশগ্রহণ সেই নব্বই দশক থেকে।
তিনি কল্পনাবিলাসী মানুষ। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যে দেশের আপামর জনগন যখন আচ্ছন্ন৷
তখন তিনি অন্যায় অবিচার দেখে চুপ থাকতে পারেন নি ৷এসবের বিরুদ্ধে তাঁর কলম সদা সোচ্ছার।বন আর লৌকিক ছড়ার অনুষঙ্গে রূপকের আড়ালে ফুটে ওঠে সে চিত্র—

বিড়াল এখন ভেড়া সাজে, ছাগল সাজে বাঘ
তাই না দেখে হরিণ মশাই করেন ভীষণ রাগ ৷
কাণ্ড এমন, গলা টেনে জিরাফ বলে হুম
বনের যত পশুপাখি, নেই কারো আর ঘুম।
হাতির ছিল বিশাল দেহ, সেও কেমন মরা
ক্যাঙ্গারুদের পায়ে দেখি সোনার নূপুর পরা
ভল্লুকেরা গুহার ভেতর,বাইরে যেতে ভয়
সন্দেহ ঠিক, রাজ্যে হঠাৎ কী যেন কী হয়।
                                     ( ছড়াঃবনরাজ্য)
কখনো ছড়াকার তার কলমেই করেছেন বিদ্রোহ তার লেখালেখিতে ৷পার করেছেন দীর্ঘসময় রাজনৈতিক দোলাচলে ৷বিভিন্ন সময় তিনি নিজেই যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বলয়ে আবদ্ধ তবু তার কলম এতটুকু বিচলিত নয় ৷শুনালেন সে বাণী ৷

ডিগবাজি গো ডিগবাজি
এইতো শহীদ,এই গাজি
নিজেই আমি তে পায়া
বিশ্বসেরা বেহায়া।
                   ‍(ছড়াঃবেহায়া)
1.
সখা,
আমার এদেশ দেশ যেন নয়, মৃত্যু উপত্যকা।
তোর সাথে ফের দেখা হবে,সম্ভাবনা কম
আমার দেশে নেমেছে আজ পুলিশরূপি যম।
                                     (ছড়াঃতুষের আগুন)
2.
হাঁটতে গেলে র্যাব ও পুলিশ,দৌড়তে গেলে দল
দেশটা যেন আমার কাছে সাহারা অঞ্চল
                                      (ছড়াঃতুষের আগুন)

3.
চলছে লড়াই,চলছে লড়াই
কার বেশি তেজ?বাড়ছে বড়াই-
দেশটা পুড়ে তপ্ত কড়াই ৷
                      (ছড়াঃবিভীষিকা)
দেশের শাসনতন্ত্র ও আর রাজনীতিবিদদের উপর ফুটে ওঠেছ তার চরম ক্ষোভ ৷ অযোগ্য মন্ত্রীদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে সাধারণ জনগন ভরসা হারিয়ে ফেলে আর সীমাহীন দূর্ভোগে পার করে দেশ তথা মাটি ৷

আমরা পাখি,আর শিকারি তারা
নেই আমাদের আজ কোন পাহারা

1.
গাড়ির চালক গরু চেনে,তিনিও চেনেন টায়ার-
এই নিয়ে রোজ মঞ্চে তিনি করেন কামান ফায়ার।
                           (ছড়াঃজুতোমন্ত্রী)
2.
ক্রেতা এবং বিক্রেতার এই অভিনব হাটবাজারে
কেউ হচ্ছে চ্যাপ্টা প্রজা,কেউ সম্রাট,কেউ রাজারে
                                 (ছড়াঃমুন্ডুকাটা)
3.
সরকারী দল ঢঙে নাচে বিরোধীরাও চামে
আমজনতার ভাগ্যে এখন অমাবশ্যা নামে
  (ছড়াঃলাঙের হরতাল)

তিনি কেবল দেশের বৈষম্য আর নিপীরণেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি, নিজের অন্তর্চক্ষু দিয়ে পরিভ্রমন করেছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ৷ তাঁর ছড়ায় ওঠে এসেছে সাম্রাজ্যবাদ আর বৈশ্বিক রাজনীতি ও আধিপত্যের শিকল ৷ তিনি তাদের মুখোশ খুলে এর কড়া জবাব দিয়েছেন ৷প্রতিবেশী দেশের নীতিহীন হত্যা মেনে নেন নি ৷ ফেলানীর মত মানুষকে যখন ভারত পাখির মত গুলি করে মারে নিয়ত তিনি বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছেন সে দৃশ্য ৷
1.
নিজের দেহে জলাতঙ্ক, পরকে সাধেন হামের টিকা,
আমেরিকা, আমেরিকা।
তার রয়েছে খুনের সনদ , আর বাকিরা গোবেচারা
উন্নয়নের ভাষণ দিয়ে বিশ্বমুলুক দেন পাহারা
ইচ্ছেখুশি গণতন্ত্রের যখন যেমন জ্বালান শিখা-
আমেরিকা, আমেরিকা।

(ছড়াঃআমেরিকা)
2.
ফেলানিকে খুন করে বি এস এফ হাসে
এরকম দৃশ্য দেখি প্রতিমাসে
বুঝিনা তো তাহাদের
আছে নাকি দিল?
বাঙালিরা গড়বেই ফের কারগিল?
               (ছড়াঃ ফেলানী)
গনতন্ত্রের স্বাধীনতা রক্ষা আর মতামত প্রকাশে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী তাই শত বাধা তাঁর কলমকে হার মানাতে পারে নি ৷ মতপ্রকাশের অধিকার আর সেই কালো আইনের দেয়াল ভেঙে বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন তাঁর ছড়ার মাধ্যমে ৷ স্বাধীনতা জনগনের কাছে ফাঁস করেছেন সব কিছু ৷
1.
কিছু লিখছো? বুকে ভয় ভয়
আহা কী হয়
লেখা ছাপবে?
ভয়ে কাঁপবে
শুধু শংকা
লভঢংকা।
(ছড়াঃ কালো আইনে)
2.
উইকিলিকসে তথ্য পাচার,এই অনাচার
যায় কি মানা?
অপরাধির তাই ত সাজা
আবুগারিব করাদখানা-
অন্য দেশেও শাসি- এমন, মানবে কেন এ
চামচিকা?
আমেরিকা, আমেরিকা।
                  (ছড়াঃআমেরিকা)
মার্কসীয় দর্শন ছড়াকারে ছিল ব্যক্তিগত জীবন ৷ পুজিবাদের আগ্রাসন তিনি সহজ ভাবে নিতে পারেন নি ৷ তাই আন্দোলনরত শ্রমিক,মজুরদের আর কৃষকদের মাঝে নিজেকে একাত্ন ঘোষণা করেছেন আর উচ্চারণ করেছেন আশার বাণী ৷ বর্ণবাদে তিনি বিশ্বাসী নন তাই অসাম্প্রদায়িকতায় ছিল তার আস্থা ৷
1.
বর্ণবাদের দুষ্ট ক্ষত যার ললাটের নিত্যসাথী
সে কী করে দাবী করে, নিজকে এমন সভ্য জাতি?
আর কোথাও ঘটলে এমন নাক
উঁচিয়ে দিচ্ছে হিকা-
আমেরিকা, আমেরিকা।
কী কৌশলে ভরবে গোলা, হোক না যতই
পরের ক্ষতি কোন দেশে কে থাকবে রাজা? কার
কী হবে পরিণতি?
সিনেট সভায় এই মহাপ্ল্যান যেমন
খুশি হচ্ছে লিখা-
আমেরিকা, আমেরিকা।
(  ছড়াঃ আমেরিকা)

2.
মন্দিরে নেই ধর্মাবতার বুদ্ধও নেই মঠে-
মসজিদে কি ত্রাতা থাকেন? দাঙ্গা ও সংকটে

(ছড়াঃমিথ্যে বড়াই করো)

তাঁর ছড়ায় স্থান পেয়েছে রোমান্টিকতা ও ভালোবাসা ৷ তাঁর ছড়ায় ভালোবাসা দেহাতীত ও নৈসর্গিক ৷
1.
অনুভূতির চোখের জ্যোতি বুকের দহন বাড়ায়-
আমার দেহের ষোলকলা ইচ্ছেমত নাড়ায়।
                                          (ছড়াঃঅনুভূতি)
2.
অনুভূতির প্রজাপতির দু চোখ টানা-টানা
রূপের মায়ায় তার তুলনা,সূর্য যে আধখানা
তার হাসিতে ঢেউ খেলে যায়-মেঘের লুকোচুরি-
সেই-ই আমার ভালোবাসার নতুন স্বপ্নপুরী  ৷
                           ( ছড়াঃঅনুভূতির প্রজাপতি)
সমকালীন সময়ের অবক্ষয় তাঁর ছড়ায় ধরা পড়েছে ঐশী প্রতীকে নতুন আঙ্গিকে যখন দেশে ছেলেমেয়েরা নেশায় বিভোর হয়ে নিজ পিতামাতাকে হত্যা করার মত হীন কাজ করে ৷মদ,জুয়া,ধর্ষণ আর চুরি ছিনতাই,সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য যখন চরমে তিনি দায়ী করেন সেই জন্মদাতাদের ৷ আর বিশ্বজিতের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় তখনো ছড়াকার চুপ থাকেন নি ৷

পিতা থাকে বাইরে বাইরে-
মায়ের হাতে সময় নাইরে
সন্তানেরা যে যার মত
ইচ্ছেমত ধায়-
কী যে শোনা যায়?
               (ছড়াঃঐশীরা)

এছাড়াও তাঁর ছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত নস্টালজিক অনুভূতি,চলে গেছেন স্মৃতি ঘেরা সেই পার্বত্য সীমানায় ৷মাতৃভক্ত এই ছড়াকার যেন শোকে বিহবল তাঁর মায়ের উপারে যাবার সন্ধিক্ষনে ৷ দারিদ্রতা তাকে যেন সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে মায়ের কোল থেকে ৷ এ যেন এক অমোঘ নিয়তি তবু তাঁর স্মৃতি শুভ্র পাথরের মত আটকে গেছে গ্রামে ৷

এই টাকা যে কাল হবে মা-এই টাকা যে সাপ-
চাইনি আমি তোর জীবনে এমন অভিশাপ।
আদুরি মা। আদুরি মা, আমার বুকে আয়-
ঢাকা এখন স্বপ্নহারা মাঠের কিনারায় ৷
                                         (ছড়াঃআদুরি মা)
1.
ঐ গ্রামের এক মাটির ঘরে আমার মায়ের
বুকের মাঝে
কাটিয়েছিলাম এই ক'টা দিন,তার
সে প্রিয় খোকার সাজে
(ছড়াঃফটিকছড়ির জুজেখালা গ্রাম)
2.
মা যে আমার
স্মৃতি হারা,কাউকে তেমন
চেনে না আর
চোখ থেকেও অন্ধ যেন,আঁধার-আঁধার
তার চারিধার
(ছড়াঃফটিকছড়ির জুজেখালা গ্রাম)

মুক্তিযুদ্ধের করুন ভয়াবহতা ও যুগে অভিশপ্ত রাজনীতিতে তিনি এখনো বাতাসে লাশের
গন্ধ পান আর এ দৃশ্য ছড়াকার গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন আর এ  থেকে মুক্তির আশাবাদে তরুন কিশোরদের মনে জাগিয়েছেন সাহস আর স্বদেশ প্রেমে দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ৷

আমার মাটিতে অসুর নেমেছে, বার-বার শতবার
এ মাটির খোকা রক্ত দিয়েছে,মানেনি তাদের হার
নব্বুয়ে ওরা আঁধার তাড়ালো , শকুন তাড়ালো কত
শোষকের বুকে চাবুক চালাতে তারা আজো উদ্ধত ৷
                                  (ছড়াঃমুক্তি আসবেই )