বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

ছড়াকার জুলফিকার শাহাদাৎ ও সমকালীন প্রসঙ্গ—রায়ান নূর

বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে জুলফিকার শাহাদাৎ একটি পরিচিত নাম। দীর্ঘ দু দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে নিয়মিত লেখালেখি করে আসছেন। ব্যক্তি জীবনে শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত ড.ইউনুসের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন ৷ ১৯৮৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে পদচারণা এ খ্যাতনামা পুরুষের।এ পর্যন্ত তাঁর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো ৷ ছড়ার পাশাপাশি কিশোর কবিতা লিখে পেয়েছেন খ্যাতি। লিখেছেন ছোটদের জন্য গল্প,কবিতা,ছড়া ও কিশোর উপন্যাস। দুই বাংলার জনগনের মুখে মুখে তাঁর ছড়া পৌছে গেছে ৷ এই কৃতিত্বের দাবী তাঁর ৷ শুধু বাংলা ছড়া নিয়েই বাংলাদেশে এই প্রথম তিনিই লিখেছেন দুটি প্রবন্ধের বই।এ বই দুটি পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

জুলফিকার শাহাদাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার ভুজপুর থানার নারায়ণ হাট ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এদেশের মাটি,মানুষ ও সামাজিক বাস্তবতা ৷ বিশেষত তার ছড়ায় স্থান পেয়েছে রাজনীতি,দেশজ ও আধুনিক সংস্কৃতি,রোমান্টিক ভাবনা,লৌকিক ব্যবহার,বিশেষভাবে সমকালীন প্রেক্ষাপট ৷ এমনকি হলুদ সাংবাদিকতা ও রাজনীতিবিদদের নীতিহীনতা তাঁর ছড়ায় আসন পেয়েছে ৷সকল রকমের ছড়াতে পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছেন এই খ্যাতনামা পুরুষ ৷ তিনি নানা রকমের
ছন্দ,রূপক,উপমা,শ্লেষ,বক্রোক্তি,লৌকিক অনুষঙ্গে ছড়ার জগতে আলোড়ন তুলেছেন ৷ সাহিত্য যখন রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,বুদ্ধদেব বসু,সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর সুকুমার রায় এর বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন এই ক্ষনজন্মা পুরুষ আধুনিক শব্দ চয়নে দেখালেন পান্ডিত্য ৷ সুদূর পার্বত্য এলাকার নৈসর্গিক প্রক়ৃতি আর প্রত্যক্ষ দেশের লোকজ,কালিক,আর ব্যক্তিগত অন্তর্দর্শনে ইতিহাস আর ঐতিহ্য বহন  করে তাঁর ছড়া ৷রাজনৈতিক পটভূমিকে এই শিল্পী এঁকেছেন আজব মেশিনের অবয়বে ৷

দেখুন দেখুন স্যার-
একটা আজব মেশিন এলো
আজগুবি কারবার।
এই মেশিনের গুনের কথা
যাচ্ছে শোনা যথাতথা-
ঢুকলে এতে পাচ্ছে সবাই হাজার উপকার-
আবার দেখি মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে রাজাকার।
রাজাকার আর আলবদরে এই মেশিনে ঢুকে-
বের হচ্ছে অন্যদিকে জয়বাংলা মুখে
                                        (ছড়াঃ আজব মেশিন)
 
বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে অতিক্রম করে তাঁর ছড়া পশ্চিম বঙ্গের জনগনের কাছেও স্থান পেয়েছে ৷কলকাতার বিভিন্ন কাগজে তাঁর ছড়া,
কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।আবৃত্তিতে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে মিডিয়ায় এসেছেন নক্ষত্র রূপে ৷বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ছড়া-কবিতা পাঠে তাঁর অংশগ্রহণ সেই নব্বই দশক থেকে।
তিনি কল্পনাবিলাসী মানুষ। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যে দেশের আপামর জনগন যখন আচ্ছন্ন৷
তখন তিনি অন্যায় অবিচার দেখে চুপ থাকতে পারেন নি ৷এসবের বিরুদ্ধে তাঁর কলম সদা সোচ্ছার।বন আর লৌকিক ছড়ার অনুষঙ্গে রূপকের আড়ালে ফুটে ওঠে সে চিত্র—

বিড়াল এখন ভেড়া সাজে, ছাগল সাজে বাঘ
তাই না দেখে হরিণ মশাই করেন ভীষণ রাগ ৷
কাণ্ড এমন, গলা টেনে জিরাফ বলে হুম
বনের যত পশুপাখি, নেই কারো আর ঘুম।
হাতির ছিল বিশাল দেহ, সেও কেমন মরা
ক্যাঙ্গারুদের পায়ে দেখি সোনার নূপুর পরা
ভল্লুকেরা গুহার ভেতর,বাইরে যেতে ভয়
সন্দেহ ঠিক, রাজ্যে হঠাৎ কী যেন কী হয়।
                                     ( ছড়াঃবনরাজ্য)
কখনো ছড়াকার তার কলমেই করেছেন বিদ্রোহ তার লেখালেখিতে ৷পার করেছেন দীর্ঘসময় রাজনৈতিক দোলাচলে ৷বিভিন্ন সময় তিনি নিজেই যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বলয়ে আবদ্ধ তবু তার কলম এতটুকু বিচলিত নয় ৷শুনালেন সে বাণী ৷

ডিগবাজি গো ডিগবাজি
এইতো শহীদ,এই গাজি
নিজেই আমি তে পায়া
বিশ্বসেরা বেহায়া।
                   ‍(ছড়াঃবেহায়া)
1.
সখা,
আমার এদেশ দেশ যেন নয়, মৃত্যু উপত্যকা।
তোর সাথে ফের দেখা হবে,সম্ভাবনা কম
আমার দেশে নেমেছে আজ পুলিশরূপি যম।
                                     (ছড়াঃতুষের আগুন)
2.
হাঁটতে গেলে র্যাব ও পুলিশ,দৌড়তে গেলে দল
দেশটা যেন আমার কাছে সাহারা অঞ্চল
                                      (ছড়াঃতুষের আগুন)

3.
চলছে লড়াই,চলছে লড়াই
কার বেশি তেজ?বাড়ছে বড়াই-
দেশটা পুড়ে তপ্ত কড়াই ৷
                      (ছড়াঃবিভীষিকা)
দেশের শাসনতন্ত্র ও আর রাজনীতিবিদদের উপর ফুটে ওঠেছ তার চরম ক্ষোভ ৷ অযোগ্য মন্ত্রীদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে সাধারণ জনগন ভরসা হারিয়ে ফেলে আর সীমাহীন দূর্ভোগে পার করে দেশ তথা মাটি ৷

আমরা পাখি,আর শিকারি তারা
নেই আমাদের আজ কোন পাহারা

1.
গাড়ির চালক গরু চেনে,তিনিও চেনেন টায়ার-
এই নিয়ে রোজ মঞ্চে তিনি করেন কামান ফায়ার।
                           (ছড়াঃজুতোমন্ত্রী)
2.
ক্রেতা এবং বিক্রেতার এই অভিনব হাটবাজারে
কেউ হচ্ছে চ্যাপ্টা প্রজা,কেউ সম্রাট,কেউ রাজারে
                                 (ছড়াঃমুন্ডুকাটা)
3.
সরকারী দল ঢঙে নাচে বিরোধীরাও চামে
আমজনতার ভাগ্যে এখন অমাবশ্যা নামে
  (ছড়াঃলাঙের হরতাল)

তিনি কেবল দেশের বৈষম্য আর নিপীরণেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি, নিজের অন্তর্চক্ষু দিয়ে পরিভ্রমন করেছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ৷ তাঁর ছড়ায় ওঠে এসেছে সাম্রাজ্যবাদ আর বৈশ্বিক রাজনীতি ও আধিপত্যের শিকল ৷ তিনি তাদের মুখোশ খুলে এর কড়া জবাব দিয়েছেন ৷প্রতিবেশী দেশের নীতিহীন হত্যা মেনে নেন নি ৷ ফেলানীর মত মানুষকে যখন ভারত পাখির মত গুলি করে মারে নিয়ত তিনি বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছেন সে দৃশ্য ৷
1.
নিজের দেহে জলাতঙ্ক, পরকে সাধেন হামের টিকা,
আমেরিকা, আমেরিকা।
তার রয়েছে খুনের সনদ , আর বাকিরা গোবেচারা
উন্নয়নের ভাষণ দিয়ে বিশ্বমুলুক দেন পাহারা
ইচ্ছেখুশি গণতন্ত্রের যখন যেমন জ্বালান শিখা-
আমেরিকা, আমেরিকা।

(ছড়াঃআমেরিকা)
2.
ফেলানিকে খুন করে বি এস এফ হাসে
এরকম দৃশ্য দেখি প্রতিমাসে
বুঝিনা তো তাহাদের
আছে নাকি দিল?
বাঙালিরা গড়বেই ফের কারগিল?
               (ছড়াঃ ফেলানী)
গনতন্ত্রের স্বাধীনতা রক্ষা আর মতামত প্রকাশে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী তাই শত বাধা তাঁর কলমকে হার মানাতে পারে নি ৷ মতপ্রকাশের অধিকার আর সেই কালো আইনের দেয়াল ভেঙে বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন তাঁর ছড়ার মাধ্যমে ৷ স্বাধীনতা জনগনের কাছে ফাঁস করেছেন সব কিছু ৷
1.
কিছু লিখছো? বুকে ভয় ভয়
আহা কী হয়
লেখা ছাপবে?
ভয়ে কাঁপবে
শুধু শংকা
লভঢংকা।
(ছড়াঃ কালো আইনে)
2.
উইকিলিকসে তথ্য পাচার,এই অনাচার
যায় কি মানা?
অপরাধির তাই ত সাজা
আবুগারিব করাদখানা-
অন্য দেশেও শাসি- এমন, মানবে কেন এ
চামচিকা?
আমেরিকা, আমেরিকা।
                  (ছড়াঃআমেরিকা)
মার্কসীয় দর্শন ছড়াকারে ছিল ব্যক্তিগত জীবন ৷ পুজিবাদের আগ্রাসন তিনি সহজ ভাবে নিতে পারেন নি ৷ তাই আন্দোলনরত শ্রমিক,মজুরদের আর কৃষকদের মাঝে নিজেকে একাত্ন ঘোষণা করেছেন আর উচ্চারণ করেছেন আশার বাণী ৷ বর্ণবাদে তিনি বিশ্বাসী নন তাই অসাম্প্রদায়িকতায় ছিল তার আস্থা ৷
1.
বর্ণবাদের দুষ্ট ক্ষত যার ললাটের নিত্যসাথী
সে কী করে দাবী করে, নিজকে এমন সভ্য জাতি?
আর কোথাও ঘটলে এমন নাক
উঁচিয়ে দিচ্ছে হিকা-
আমেরিকা, আমেরিকা।
কী কৌশলে ভরবে গোলা, হোক না যতই
পরের ক্ষতি কোন দেশে কে থাকবে রাজা? কার
কী হবে পরিণতি?
সিনেট সভায় এই মহাপ্ল্যান যেমন
খুশি হচ্ছে লিখা-
আমেরিকা, আমেরিকা।
(  ছড়াঃ আমেরিকা)

2.
মন্দিরে নেই ধর্মাবতার বুদ্ধও নেই মঠে-
মসজিদে কি ত্রাতা থাকেন? দাঙ্গা ও সংকটে

(ছড়াঃমিথ্যে বড়াই করো)

তাঁর ছড়ায় স্থান পেয়েছে রোমান্টিকতা ও ভালোবাসা ৷ তাঁর ছড়ায় ভালোবাসা দেহাতীত ও নৈসর্গিক ৷
1.
অনুভূতির চোখের জ্যোতি বুকের দহন বাড়ায়-
আমার দেহের ষোলকলা ইচ্ছেমত নাড়ায়।
                                          (ছড়াঃঅনুভূতি)
2.
অনুভূতির প্রজাপতির দু চোখ টানা-টানা
রূপের মায়ায় তার তুলনা,সূর্য যে আধখানা
তার হাসিতে ঢেউ খেলে যায়-মেঘের লুকোচুরি-
সেই-ই আমার ভালোবাসার নতুন স্বপ্নপুরী  ৷
                           ( ছড়াঃঅনুভূতির প্রজাপতি)
সমকালীন সময়ের অবক্ষয় তাঁর ছড়ায় ধরা পড়েছে ঐশী প্রতীকে নতুন আঙ্গিকে যখন দেশে ছেলেমেয়েরা নেশায় বিভোর হয়ে নিজ পিতামাতাকে হত্যা করার মত হীন কাজ করে ৷মদ,জুয়া,ধর্ষণ আর চুরি ছিনতাই,সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য যখন চরমে তিনি দায়ী করেন সেই জন্মদাতাদের ৷ আর বিশ্বজিতের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় তখনো ছড়াকার চুপ থাকেন নি ৷

পিতা থাকে বাইরে বাইরে-
মায়ের হাতে সময় নাইরে
সন্তানেরা যে যার মত
ইচ্ছেমত ধায়-
কী যে শোনা যায়?
               (ছড়াঃঐশীরা)

এছাড়াও তাঁর ছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত নস্টালজিক অনুভূতি,চলে গেছেন স্মৃতি ঘেরা সেই পার্বত্য সীমানায় ৷মাতৃভক্ত এই ছড়াকার যেন শোকে বিহবল তাঁর মায়ের উপারে যাবার সন্ধিক্ষনে ৷ দারিদ্রতা তাকে যেন সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে মায়ের কোল থেকে ৷ এ যেন এক অমোঘ নিয়তি তবু তাঁর স্মৃতি শুভ্র পাথরের মত আটকে গেছে গ্রামে ৷

এই টাকা যে কাল হবে মা-এই টাকা যে সাপ-
চাইনি আমি তোর জীবনে এমন অভিশাপ।
আদুরি মা। আদুরি মা, আমার বুকে আয়-
ঢাকা এখন স্বপ্নহারা মাঠের কিনারায় ৷
                                         (ছড়াঃআদুরি মা)
1.
ঐ গ্রামের এক মাটির ঘরে আমার মায়ের
বুকের মাঝে
কাটিয়েছিলাম এই ক'টা দিন,তার
সে প্রিয় খোকার সাজে
(ছড়াঃফটিকছড়ির জুজেখালা গ্রাম)
2.
মা যে আমার
স্মৃতি হারা,কাউকে তেমন
চেনে না আর
চোখ থেকেও অন্ধ যেন,আঁধার-আঁধার
তার চারিধার
(ছড়াঃফটিকছড়ির জুজেখালা গ্রাম)

মুক্তিযুদ্ধের করুন ভয়াবহতা ও যুগে অভিশপ্ত রাজনীতিতে তিনি এখনো বাতাসে লাশের
গন্ধ পান আর এ দৃশ্য ছড়াকার গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন আর এ  থেকে মুক্তির আশাবাদে তরুন কিশোরদের মনে জাগিয়েছেন সাহস আর স্বদেশ প্রেমে দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ৷

আমার মাটিতে অসুর নেমেছে, বার-বার শতবার
এ মাটির খোকা রক্ত দিয়েছে,মানেনি তাদের হার
নব্বুয়ে ওরা আঁধার তাড়ালো , শকুন তাড়ালো কত
শোষকের বুকে চাবুক চালাতে তারা আজো উদ্ধত ৷
                                  (ছড়াঃমুক্তি আসবেই )